সাতটা ক্লাস, হোমওয়ার্ক, আর নতুন ক্লাসটেস্টের টেনশন এর মাঝেও আলো ছিল প্রাণবন্ত। স্কুলের মাঠে কাবাডি খেলত, বান্ধবীদের নিয়ে হাসির রোল তুলত। কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি, এই প্রাণবন্ত মেয়েটিই একদিন ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বে সবকিছুর শেষ করে দেওয়ার চেষ্টায়।
জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার উলফাতুননেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সাথী আক্তার, যাকে সবাই আলো নামেই চিনত, এখন নিটোর হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। একটি ভুল বোঝাবুঝি, কিছু অপমানজনক কথা, এবং হয়তো একটি ক্ষমাহীন মন সব মিলে আলোকে ঠেলে দিয়েছে জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার মোড়ে।
তিন মাস আগের ঘটনা। সাবেক প্রধান শিক্ষক আতাউর রহমান কিছু ছাত্রীকে ভূমি অফিসের এক কুইজে অংশ নিতে পাঠান। প্রতিযোগিতা শেষে কয়েকজন ছাত্রী মসজিদে নূর এলাকায় কিছু সময় কাটায়। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে দেখা হয়ে যায় বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নূর মোহাম্মদের সঙ্গে। বিষয়টি তিনি তৎকালীন প্রধান শিক্ষককে জানান, যিনি শুধু মৌখিকভাবে সতর্ক করেছিলেন।
কিন্তু গল্পটা এখানেই থেমে থাকেনি, নূর মোহাম্মদ ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সাথীকে লক্ষ্য করে চলতে থাকে মানসিক চাপ। বারবার তার অভিভাবককে আনার কথা বলা হয়। বান্ধবীদের মতে, তিনি প্রায়ই সাথীকে ক্লাসে ডেকে শাসাতেন।
সেই সকালেও আলো খেলাধুলা করছিল, মাঠে দাগ কেটেছিল কাবাডির জন্য। হাসিমুখে ছিল, লিডার হিসেবেও নির্বাচিত হয়। কিন্তু একটু পরই শ্রেণিকক্ষে প্রধান শিক্ষক ঢুকে পড়েন। আবারও একই কথা, আবারও একই রাগ। সবার সামনে চোখের পানি ফেলেও যখন ক্ষমা চেয়ে কাজ হয়নি, তখন হয়তো আলো বিশ্বাস করেছিল তার কথা আর কেউ শুনবে না। পরে স্কুলের ছয়তলা ভবনের ছাদে উঠে পড়ে। এক ঝাঁপ যেখানে সে চেয়েছিল সব দুঃখ শেষ হয়ে যাক।
তার বড় বোন আখির প্রশ্ন আজ সবার মনেই আমাদের নম্বর তো স্কুলের ফর্মেই ছিল, তাহলে শিক্ষক আমাদের ডাকলেন না কেন? শুধু আমার ছোট বোনকেই কেন চাপ দেওয়া হলো? এটা কি কোনো শিক্ষকসুলভ আচরণ?
প্রধান শিক্ষক নূর মোহাম্মদ বলছেন, তিনি শুধু অভিভাবক আনতে বলেছিলেন। তার কথায় কোনো অতিরিক্ত কিছু ছিল না। কিন্তু একজন কিশোরী কেন এমন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে? কতটা চাপ থাকলে একটি শিশু ছাদ থেকে লাফ দেয়? এর উত্তর কি শুধু শাসন ?
আলো এখনো জীবিত, কিন্তু আহত গোটা সমাজ। আলো এখনো বেঁচে আছে চিকিৎসাধীন। কিন্তু তার এই পতনের শব্দ কাঁপিয়ে দিয়েছে পুরো সমাজকে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কের জায়গাটা যদি ভয় আর অপমানের হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আর কিসে ভরসা পাবে শিশুরা?
শুধু আলো নয়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপরও প্রশ্ন উঠেছে। একটি স্কুলের পরিবেশ, একজন শিক্ষকের ব্যবহার এসবই নির্ধারণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস। আর সেই জায়গা যদি অন্ধকারে ঢেকে যায়, তবে সত্যিকারের আলো কোথা থেকে আসবে?
আলো আজ নিটোরের একটি বিছানায় শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে, নিঃশব্দে চিৎকার করে যাচ্ছে তার যন্ত্রণা। আমরা কি শুনতে পাচ্ছি সেই কান্না?
না শুনলে, হয়তো আরও অনেক আলো আত্মহত্যার ছাদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
Editor and Publisher : Ariful Islam
Address: Nikunja-2, Road No. 1/A Cemetery Road, Dhaka
Call: 8809639113691
E-mail: Ajkerkhobur@gmail.com
@2025 | Ajker-Khobor.com