
চট্টগ্রামের উত্তরে অবস্থিত সীতাকুণ্ড উপজেলা একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার, অন্যদিকে দেশের ভারী শিল্পাঞ্চলের অন্যতম কেন্দ্র। চন্দ্রনাথ পাহাড়, গুলিয়াখালী সৈকত, সহস্রধারা ঝরনা কিংবা ইস্পাত শিল্পের ধোঁয়া — সব মিলিয়ে সীতাকুণ্ড যেন প্রকৃতি আর প্রগতি, দুইয়ের মেলবন্ধন। তবে এই সম্ভাবনার ভিড়ে চাপা পড়ে আছে কিছু পুরনো ও গুরুতর সংকট, যা উন্নয়নের গতিকে বারবার থামিয়ে দিচ্ছে।
সম্ভাবনার সীতাকুণ্ড :
সীতাকুণ্ডে যেমন রয়েছে পাহাড়-নদী-সাগরের মায়া, তেমনি রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় ইস্পাত শিল্পের ঘাঁটি। এখানে প্রতিদিন গড়ে উঠছে নতুন কারখানা, প্রসারিত হচ্ছে রপ্তানিমুখী শিল্প। পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্রগুলোর উন্নয়ন হলে এই অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে চট্টগ্রামের বিকল্প পর্যটন হাব।
পর্যটনের অপার সম্ভাবনা-
চন্দ্রনাথ ধাম, সহস্রধারা ঝরনা, গুলিয়াখালী সৈকত — এসব জায়গায় দেশ-বিদেশের পর্যটকের আনাগোনা বাড়ছে, তবে মৌসুমি ও অপরিকল্পিতভাবে। টেকসই অবকাঠামো ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এগুলোকে বাণিজ্যিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুললে স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব।
শিল্প ও কর্মসংস্থান-
সীতাকুণ্ডে ইস্পাত, ঢেউটিন ও শিপইয়ার্ড শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। শিল্পাঞ্চল বিস্তৃত হলেও স্থানীয় জনগণের জন্য টেকসই ও সুষ্ঠু কর্মসংস্থান এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। ন্যায্য মজুরি, প্রশিক্ষণ ও শ্রমিক সুরক্ষার ওপর জোর দিলে এই সমস্যা অনেকটাই নিরসনযোগ্য।
উপকূলীয় বন্দর সম্ভাবনা-
উপকূল ঘেঁষা অবস্থান এবং ঢাকার সাথে রেল ও সড়ক যোগাযোগের সহজলভ্যতা সীতাকুণ্ডকে একটি সম্ভাব্য ‘মিডল-পোর্ট’ হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি করেছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে এই অঞ্চল দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র হতে পারে।
সংকটে বন্দি সম্ভাবনা :
সম্ভাবনার দীর্ঘ তালিকায় বিরাজ করলেও, কিছু বাস্তব ও দীর্ঘস্থায়ী সংকট বারবার সীতাকুণ্ডের অগ্রগতির পথ বাধাগ্রস্ত করছে।
পরিবেশ দূষণ: এক নীরব বিপর্যয় –
সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্প, ইস্পাত কারখানা ও অন্যান্য ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিনিয়ত নির্গত হচ্ছে বিষাক্ত বর্জ্য। এসব বর্জ্য মাটি, পানি ও বায়ুকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ ও পানিবাহিত রোগের হার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন — দ্রুত সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করলে এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার বাধ্যতামূলক না করলে সীতাকুণ্ডে এক ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকট দেখা দিতে পারে। এখনই সময় সমস্যাকে স্বীকার করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের।
ভূগর্ভস্থ পানির সংকট –
সীতাকুণ্ডে শিল্পখাতে পানির চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধির ফলে ভূগর্ভস্থ পানি অতিরিক্ত হারে উত্তোলন করা হচ্ছে, যার ফলে পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নামছে। এর পাশাপাশি, কিছু শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি মাটিতে বা জলাশয়ে মিশে গিয়ে পানির উৎসগুলোকে দূষিত করছে। ফলে নিরাপদ পানীয়জলের সংকটে পড়ছে স্থানীয় জনগণ। অনেক এলাকায় টিউবওয়েল ও নলকূপের পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এই সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজন সময়োপযোগী পানি ব্যবস্থাপনা নীতি ও শিল্পাঞ্চলে পরিবেশবান্ধব বর্জ্য শোধন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি –
উপকূলীয় ও পাহাড়বেষ্টিত অঞ্চল হওয়ায় সীতাকুণ্ড ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প এবং পাহাড়ি ঢলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে প্রায়ই পড়ে। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে আসা ঢলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়, আর উপকূলে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে বসতবাড়ি ও কৃষিজমিতে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এসব দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় আশ্রয়কেন্দ্র, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক এবং জরুরি সরঞ্জামের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। ফলে দুর্যোগের সময় ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সুষ্ঠু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ও দ্রুত বাস্তবায়ন ছাড়া এ ঝুঁকি কমানো সম্ভব নয়।
দুর্বল অবকাঠামো: অগ্রগতির পথে বড় বাধা –
সীতাকুণ্ডকে একটি আধুনিক বন্দরনগরী বা শিল্প ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন যথাযথ অবকাঠামো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনো এ অঞ্চলে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পরিবহন ব্যবস্থায় রয়েছে গুরুতর ঘাটতি। শিল্প কারখানাগুলো নিয়মিত গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের শিকার হয়, যার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে, পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকাংশেই ভাঙাচোরা ও অনিরাপদ। যথাযথ অবকাঠামোগত বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা ছাড়া সীতাকুণ্ডের সম্ভাবনাগুলো পূর্ণতা পাবে না — বরং পিছিয়ে পড়বে প্রতিযোগিতার দৌড়ে।
সমাধানের পথ: সমন্বিত পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা –
সীতাকুণ্ডের সংকট ও সম্ভাবনাগুলো দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্টদের নজরে থাকলেও এখনো পর্যন্ত কোনও সুসমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আলোর মুখ দেখেনি এই অঞ্চল। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে — কখনো কোনো খাতকে গুরুত্ব দিয়ে, আবার কখনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ছাড়াই। ফলে সমস্যার মূল জায়গাগুলো থেকেই গেছে অবহেলিত।
এখন সময়, পরিকল্পনায় সমন্বয়, বাস্তবায়নে আন্তরিকতা এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে সুদূরদর্শিতা দেখানোর। পরিবেশ সংরক্ষণ, শিল্পায়ন, পর্যটন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা — সবকিছুর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে সীতাকুণ্ডকে একটি টেকসই, কর্মসংস্থানসমৃদ্ধ ও বাসযোগ্য অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আর তা সম্ভব একমাত্র দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনা ও দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে।
প্রয়োজন —
পরিবেশবান্ধব শিল্প নীতিমালা
দুর্যোগ মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি ও সচেতনতা
পর্যটন কেন্দ্রের নিরাপত্তা ও সু-শৃঙ্খল বাণিজ্যিকায়ন
উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও মজবুত অবকাঠামো
স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও দক্ষতা উন্নয়ন
ইতি কথা –
সীতাকুণ্ড শুধু একটি উপজেলা নয়, এটি সম্ভাবনার এক ‘রোডম্যাপ’ — যদি পরিকল্পনা থাকে, সদিচ্ছা থাকে। একদিকে পাহাড়ের সবুজ, অন্যদিকে ধোঁয়ামোড়া শিল্পাঞ্চল; এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সীতাকুণ্ড বলছে — “আমাকে গড়ো, আমি পাল্টে দেব দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট।”