১২:০৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সীতাকুণ্ড উপকূলে বাঁধহীন জনপদ

১৯৯১-এর সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় পেরিয়ে গিয়েছে তিন দশকেরও বেশি সময়, কিন্তু সীতাকুণ্ডের কুমিরা ও সোনাইছড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দারা এখনও প্রতিটি জোয়ারের সঙ্গে নতুন আতঙ্ক বয়ে আনেন। সাগরের ধাক্কা ঠেকাতে সেবার যেভাবে তড়িঘড়ি করে যশোরী বেড়িবাঁধ তোলা হয়েছিল, সেটি এখন ভেঙে-বিলীন—বড় অংশ দখলে নিয়েছে জাহাজভাঙা ইয়ার্ড। ফলে আলেকদিয়া থেকে সিটি গেট পর্যন্ত নয় কিলোমিটার উপকূলে সমুদ্র আর জনপদ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

সমুদ্রের মুখে জনপদ –

জোয়ারে জল, ভাটায় কাদা: প্রতিদিনই বাড়িঘর, সড়ক, ফসলি জমি লবণাক্ত জলে ডুবে যায়; ভাটার পরে কাদায় থেঁতলে যায় যাতায়াত।

শিক্ষা ও জীবিকায় বিপর্যয়: হাঁটু-জল মাড়িয়ে স্কুলে পৌঁছতে হয় শিশুদের; বৃষ্টির মৌসুমে শিক্ষ কার্য ক্রম ব্যহত । সদা ক্ষতির ভয় নিয়েই দিনকাটে পরিবারগুলো

দুর্যোগে নিঃস্ব, তবু উপকূল ছাড়তে নারাজ –

ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীগর্ভে বিলীন—শত শত পরিবার ঘরহারা হয়েছে বারবার, কিন্তু দারিদ্র্য ও বিকল্পের অভাবে এখানেই টিকে আছেন।  স্থানীয় এক জেলে বলেন, ‘আমাদের ঘর ভাসায় যে পানি, সেই পানিই তো নৌকা বেয়ে আমাদের পেটও ভরায়’।

বাঁধ বনাম ইয়ার্ড—অচল লড়াই –

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, “জমি অধিগ্রহণ না করে টেকসই বাঁধ সম্ভব নয়।”
ইয়ার্ড মালিকদের পাল্টা বক্তব্য, “দলিলমূলে জমি কিনেছি; জাহাজভাঙা শিল্পে হাজার মানুষ কাজ করে, সরকারও রাজস্ব পায়—শিল্প গুটিয়ে বাঁধ তোলা যুক্তিযুক্ত নয়।”

জমি ছাড়ো–বাঁধ তোলো: দুই পক্ষের টানাপড়েনে বছর কেটে যাচ্ছে।

সরকারি নোটিশও অকার্যকর: দখল ছাড়ার নির্দেশ বারবার দেওয়া হলেও বেশির ভাগ ইয়ার্ড এখনও বাঁধের জমি আঁকড়ে আছে।

স্থানীয়দের জীবনরক্ষায় পাঁচ দাবি –

-টেকসই সুপ্রশস্ত বেড়িবাঁধ—সমুদ্রের আঘাত সামাল দিতে স্থায়ী কাঠামো।

-স্বচ্ছ ভূমি জরিপ ও অধিগ্রহণ-নীতিমালা—কে কতটুকু জমি দেবে, সেটা স্পষ্ট করা।

-দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্র—ঝড়ের আগাম বার্তায় নিরাপদ ঠাঁই নিশ্চিত করা।

-ইয়ার্ড এলাকায় কঠোর পরিবেশ ছাড়পত্র—জলের স্বাভাবিক পথ যাতে বন্ধ না হয়।

-বাঁধ রক্ষায় আইনি সক্রিয়তা—দখলদারিত্বে প্রশাসনের জিরো টলারেন্স প্রদর্শন।

পাউবোর অচলাবস্থার স্বীকারোক্তি –

নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহম্মেদ জানান,“বাঁধের জমি ছাড়া কাজ এগোনো যাবে না।  মন্ত্রণালয় আইনি পদক্ষেপ নিলে প্রকল্পের নকশা ও নির্মাণ আমরা দ্রুত শুরু করতে পারব।” কিন্তু জনগণের প্রশ্ন, কবে ? বর্ষা মানে আবারও ভাঙন, আবারও ঘরহারা হওয়া।

ইতি কথা-

শিল্প-রাজস্ব আর উপকূলবাসীর জীবন নিরাপত্তার দ্বন্দ্বে আজ অস্তিত্বের দোলাচলে। সমুদ্রের প্রতিটি ঢেউ এখানে কেবল স্মৃতি নয়—আগাম দিনের সতর্কবার্তা। তাই সমন্বিত সিদ্ধান্ত, আইনি দৃঢ়তা ও টেকসই পরিকল্পনা নিয়েই উপকূলের মানুষকে বাঁচানোর সময় এখন, না হলে পরের বড় ঢেউ আরেকটি ১৯৯১-কে আবারও ইতিহাসে ফিরিয়ে আনবে।

ট্যাগঃ
প্রতিনিধির তথ্য

জনপ্রিয় পোস্ট

ওষুধ খাওয়া হলোনা ছেলের, ওষুধ কিনতে গিয়ে নছিমনের ধাক্কায় কৃষক বাবার মৃত্যু

সীতাকুণ্ড উপকূলে বাঁধহীন জনপদ

পোস্ট হয়েছেঃ ০৮:৪৯:৫৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫

১৯৯১-এর সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় পেরিয়ে গিয়েছে তিন দশকেরও বেশি সময়, কিন্তু সীতাকুণ্ডের কুমিরা ও সোনাইছড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দারা এখনও প্রতিটি জোয়ারের সঙ্গে নতুন আতঙ্ক বয়ে আনেন। সাগরের ধাক্কা ঠেকাতে সেবার যেভাবে তড়িঘড়ি করে যশোরী বেড়িবাঁধ তোলা হয়েছিল, সেটি এখন ভেঙে-বিলীন—বড় অংশ দখলে নিয়েছে জাহাজভাঙা ইয়ার্ড। ফলে আলেকদিয়া থেকে সিটি গেট পর্যন্ত নয় কিলোমিটার উপকূলে সমুদ্র আর জনপদ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

সমুদ্রের মুখে জনপদ –

জোয়ারে জল, ভাটায় কাদা: প্রতিদিনই বাড়িঘর, সড়ক, ফসলি জমি লবণাক্ত জলে ডুবে যায়; ভাটার পরে কাদায় থেঁতলে যায় যাতায়াত।

শিক্ষা ও জীবিকায় বিপর্যয়: হাঁটু-জল মাড়িয়ে স্কুলে পৌঁছতে হয় শিশুদের; বৃষ্টির মৌসুমে শিক্ষ কার্য ক্রম ব্যহত । সদা ক্ষতির ভয় নিয়েই দিনকাটে পরিবারগুলো

দুর্যোগে নিঃস্ব, তবু উপকূল ছাড়তে নারাজ –

ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীগর্ভে বিলীন—শত শত পরিবার ঘরহারা হয়েছে বারবার, কিন্তু দারিদ্র্য ও বিকল্পের অভাবে এখানেই টিকে আছেন।  স্থানীয় এক জেলে বলেন, ‘আমাদের ঘর ভাসায় যে পানি, সেই পানিই তো নৌকা বেয়ে আমাদের পেটও ভরায়’।

বাঁধ বনাম ইয়ার্ড—অচল লড়াই –

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, “জমি অধিগ্রহণ না করে টেকসই বাঁধ সম্ভব নয়।”
ইয়ার্ড মালিকদের পাল্টা বক্তব্য, “দলিলমূলে জমি কিনেছি; জাহাজভাঙা শিল্পে হাজার মানুষ কাজ করে, সরকারও রাজস্ব পায়—শিল্প গুটিয়ে বাঁধ তোলা যুক্তিযুক্ত নয়।”

জমি ছাড়ো–বাঁধ তোলো: দুই পক্ষের টানাপড়েনে বছর কেটে যাচ্ছে।

সরকারি নোটিশও অকার্যকর: দখল ছাড়ার নির্দেশ বারবার দেওয়া হলেও বেশির ভাগ ইয়ার্ড এখনও বাঁধের জমি আঁকড়ে আছে।

স্থানীয়দের জীবনরক্ষায় পাঁচ দাবি –

-টেকসই সুপ্রশস্ত বেড়িবাঁধ—সমুদ্রের আঘাত সামাল দিতে স্থায়ী কাঠামো।

-স্বচ্ছ ভূমি জরিপ ও অধিগ্রহণ-নীতিমালা—কে কতটুকু জমি দেবে, সেটা স্পষ্ট করা।

-দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্র—ঝড়ের আগাম বার্তায় নিরাপদ ঠাঁই নিশ্চিত করা।

-ইয়ার্ড এলাকায় কঠোর পরিবেশ ছাড়পত্র—জলের স্বাভাবিক পথ যাতে বন্ধ না হয়।

-বাঁধ রক্ষায় আইনি সক্রিয়তা—দখলদারিত্বে প্রশাসনের জিরো টলারেন্স প্রদর্শন।

পাউবোর অচলাবস্থার স্বীকারোক্তি –

নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহম্মেদ জানান,“বাঁধের জমি ছাড়া কাজ এগোনো যাবে না।  মন্ত্রণালয় আইনি পদক্ষেপ নিলে প্রকল্পের নকশা ও নির্মাণ আমরা দ্রুত শুরু করতে পারব।” কিন্তু জনগণের প্রশ্ন, কবে ? বর্ষা মানে আবারও ভাঙন, আবারও ঘরহারা হওয়া।

ইতি কথা-

শিল্প-রাজস্ব আর উপকূলবাসীর জীবন নিরাপত্তার দ্বন্দ্বে আজ অস্তিত্বের দোলাচলে। সমুদ্রের প্রতিটি ঢেউ এখানে কেবল স্মৃতি নয়—আগাম দিনের সতর্কবার্তা। তাই সমন্বিত সিদ্ধান্ত, আইনি দৃঢ়তা ও টেকসই পরিকল্পনা নিয়েই উপকূলের মানুষকে বাঁচানোর সময় এখন, না হলে পরের বড় ঢেউ আরেকটি ১৯৯১-কে আবারও ইতিহাসে ফিরিয়ে আনবে।