০৯:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কুবিতে যৌন হয়রানির অভিযোগে শাস্তি: অভিযুক্ত শিক্ষকদের পক্ষে সাফাই গাইলেন সিন্ডিকেট সদস্য আমজাদ হোসেন

  • Yunus Sujon
  • পোস্ট হয়েছেঃ ০৭:০২:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
  • 58
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আলী রেজওয়ান তালুকদার এবং ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে শাস্তির সুপারিশ করা হলেও অভিযুক্তদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি দিয়েছেন সিন্ডিকেট সদস্য ও মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন সরকার। চিঠিতে অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দেয়া শাস্তি ‘মাত্রাতিরিক্ত’ এবং তা সিন্ডিকেট কর্তৃক পুনঃবিবেচনা করতে বলেছেন।
যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের পক্ষে সাফাই গেয়ে তিনি শিক্ষকতার নৈতিক ভিত্তি ক্ষুণ্ন করেছেন—এমন মন্তব্য করেছেন একাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী। তাদের দাবি, এ ধরনের অবস্থান সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে তাঁর উপযুক্ততা নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
জানা যায়, ২০২০ সালে ইংরেজি বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে তৎকালীন বিভাগীয় চেয়ারম্যান আলী রেজওয়ান তালুকদারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ওঠে, তার অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়া এবং ঐসকল বিষয়ে তথ্য ফোনে থাকায় পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীর ফোনের সিমকার্ড পরিবর্তন ও মেমোরি নষ্ট করে ফেলেন। অভিযোগকারী দাবি করেন, শিক্ষক আলী রেজওয়ান আগেও তাকে বিভিন্ন সময় নিজের কক্ষে বা বাসায় আসার প্রস্তাব দিয়েছেন এবং ক্লাসে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন।
অন্যদিকে, মো. জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একাধিক অভিযোগ ওঠে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, তিনি বিবাহিত নারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে ক্লাসে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করেন। এক শিক্ষার্থীকে বলেন, “জামাইয়ের সাথে থাকতে থাকতে বালতি হয়ে গেছো।” আবার ঢাকায় থাকার কারণে এক শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকায় তাকে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে বলেন, “তুমি ঢাকা ছিলা, তোমাকে খুললো কে?”
এছাড়া, ২০২২ সালের ২১ আগস্ট বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের চতুর্থ সেমিস্টারের ‘বিজনেস স্ট্যাটিস্টিকস’ কোর্সের ভাইভা চলাকালে এক ছাত্রী পর্দা করায় তাকে ‘মৌলবাদী জঙ্গি’ বলে আখ্যায়িত করেন জসিম উদ্দিন। সেই শিক্ষার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় ‘ম্যানার’ না জানার অজুহাতে অপমানও করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসকল অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট সাপেক্ষে এবং সিন্ডিকেট সভায় আলোচনার মাধ্যমে অভিযুক্ত দুই শিক্ষককে সম্প্রতি শাস্তিস্বরূপ পদাবনতি দেওয়া হয়।
তবে সম্প্রতি রেজিস্ট্রার দপ্তরে জমা দেওয়া চিঠিতে যৌন হয়রানির অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের পক্ষে সাফাই গেয়ে রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি দিয়েছেন আমজাদ। তিনি চিঠিতে বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট সভায় যে শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা ‘মাত্রাতিরিক্ত’ এবং কিছু শাস্তির বিষয়ে সিন্ডিকেটে আলোচনা হয় নি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অনেকেই তাঁর এই অবস্থানকে যৌন হয়রানিকে আড়াল দেওয়ার স্পষ্ট প্রয়াস হিসেবে দেখছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন সিন্ডিকেট সদস্য হয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্তদের পক্ষে কথা বলা যেমন অনৈতিক, তেমনি এটি ভুক্তভোগীদের প্রতি চরম অসম্মান। এছাড়াও তিনি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও সিন্ডিকেট সিদ্ধান্তকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
জানা যায়, গত ২৫ জুন রেজিস্ট্রার বরাবর আমজাদ হোসেন একটি চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ১০৩তম সিন্ডিকেট সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং সেখানে আলোচ্যসূচী-২৭ ও ৩১-এর অধীনে যথাক্রমে ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আলী রেজওয়ান তালুকদার এবং ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তা নিয়ে তাঁর আপত্তি রয়েছে। তাঁর দাবি, তদন্ত প্রতিবেদন সম্পূর্ণভাবে সভায় পঠিত হয়নি এবং কিছু শাস্তির বিষয়ে সভায় কোনো আলোচনাও হয়নি।
তবে সিন্ডিকেটের একাধিক সদস্য বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের ভাষ্য, সিন্ডিকেটে যে-সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই নেয়া হয়েছে এবং এ বিষয়ে সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে নেয়া হয়নি, বরং সব সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে।
এ বিষয়ে সিন্ডিকেট সদস্য ও উপ-উপাচার্য ড. মাসুদা কামাল বলেন, সাধারণত সিন্ডিকেট সভায় পর্যালোচনা ও মতামতে মাধ্যমেই যে কোনো সিদ্ধান্ত আসে। সেই অনুযায়ী অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের বিষয়েও পর্যালোচনার মাধ্যমে শাস্তির সিদ্ধান্ত এসেছে। সিন্ডিকেট সদস্য ও প্রক্টর আব্দুল হাকিম বলেন, আমি সিন্ডিকেট সভয় উপস্থিত ছিলাম। আর সকল সিন্ডিকেট সদস্যদের মতামত ও পর্যালোচনার মাধ্যমেই তাদের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে।
চিঠিতে আমজাদ হোসেন আরো লিখেছেন, অভিযুক্ত আলী রেজওয়ান তালুকদারের বিরুদ্ধে আনীত মোবাইল সিম ও মেমোরি কার্ড অপসারণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি এবং যৌন হয়রানির প্রমাণও যথেষ্ট নয়। একইভাবে, জসিম উদ্দিনের ক্ষেত্রেও যৌন হয়রানি প্রমাণিত হয়নি। চিঠিতে আমজাদ হোসেন যৌন হয়রানির পাশাপাশি বডি শেমিং-এর অভিযোগকে হালকাভাবে দেখেছেন বলেও দেখা গেছে। তিনি লেখেন, “শুধুমাত্র পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে অসতর্কতা ও বডি শেমিং এর কিছু লক্ষণ পাওয়া গেছে। এ প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি তাঁকে যে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তা মাত্রাতিরিক্ত।” এ বক্তব্যকে অনেকেই বডি শেমিং এবং যৌন হয়রানির গুরুত্ব খাটো করার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন।
সিন্ডিকেট সদস্য ও একজন শিক্ষক হয়ে যৌন হয়রানির মত কাজকের পক্ষে সাফাই গাওয়া ও প্রকাশ্য অবস্থান নেওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার সংগঠন “সোচ্চার স্টুডেন্ট’স নেটওয়ার্ক, কুবি”র সভাপতি নাইমুর রহমান ভূইয়া বলেন, একজন সিন্ডিকেট সদস্য হয়ে যৌন হয়রানির পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করার চেষ্টা করা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও শিক্ষার্থীদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।” তিনি আরও বলেন, “বডি শেমিংকে কেউ যদি গুরুতর অপরাধ মনে না করেন, তবে সেটি তার চিন্তার দীনতার প্রকাশ করে। এই মানসিকতা থেকেই যৌন হয়রানিকে হালকাভাবে দেখার সংস্কৃতি জন্ম নেয়। আমরা আশা রাখি সিন্ডিকেট ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় অনড় থাকবে”
আইন বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক বলেন, ‘শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির ঘটনা অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক একটি ‘ফিডুশিয়ারি রিলেশন’ বা আস্থাভিত্তিক সম্পর্কের অন্তর্ভুক্ত, যেখানে ‘অযৌক্তিক প্রভাব’ (Undue Influence) প্রয়োগ করা অন্যায়। এ ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অপরাধীর সামাজিক অবস্থান, চরিত্র এবং পেশাগত দায়বদ্ধতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাধারণত নিজেদের সবচেয়ে নিরাপদ মনে করে তাদের শিক্ষকদের ছায়াতলে। কিন্তু সেই শিক্ষকের কাছ থেকেই যদি কোনো অনৈতিক ও অপরাধমূলক আচরণ আসে, তা হলে তা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমন অপরাধকে কেউ যদি এই যুক্তিতে ছোট করে দেখায় যে শিক্ষার্থীকে ‘বডি শেমিং’ করা তেমন বড় অপরাধ না, তাহলে তিনি অন্যায়কে সমর্থন করছেন। শিক্ষার্থীদের জীবনে শিক্ষক হচ্ছেন একজন অভিভাবকের মতো।’
ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম শরিফুল করীম বলেন, বডি শেমিং ও যৌন হয়রানি, এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ তা করে থাকলে অবশ্যই শাস্তি পাবে। আর এটার পক্ষ কেউ নিয়ে থাকলে কোন ভিত্তিতে নিয়েছে তার উপর নির্ভর করে তা ঠিক কি ঠিক না।
এ বিষয়ে যৌন হয়রানি সেলের সদস্য সচিব শারমিন রেজোয়ানা বলেন, “বডি শেমিং করা কিংবা যৌন হয়রানি মূলক যে কোন উক্তি করাও যৌন হয়রানির আওতায় পড়ে। এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দেওয়া আছে।”
যৌন হয়রানির পক্ষ নিয়ে কথা বলার বিষয়ে তিনি বলেন, “সবাই নিজেদের ব্যক্তিগত মতামত দিতে পারেন। তবে যৌন হয়রানির মত এমন বিষয়ে পক্ষ নেওয়া নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না।”
যৌন হয়রানির পক্ষ নিয়ে চিঠি দেওয়া নিয়ে আমজাদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান এবং প্রতিবেদকের ফোন কেটে দেন।
ট্যাগঃ
প্রতিনিধির তথ্য

জনপ্রিয় পোস্ট

বেইহাং বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা গ্রাজুয়েট অ্যাওয়ার্ড পেলেন রাণীনগরের তরিকুল ইসলাম

কুবিতে যৌন হয়রানির অভিযোগে শাস্তি: অভিযুক্ত শিক্ষকদের পক্ষে সাফাই গাইলেন সিন্ডিকেট সদস্য আমজাদ হোসেন

পোস্ট হয়েছেঃ ০৭:০২:১৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আলী রেজওয়ান তালুকদার এবং ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে শাস্তির সুপারিশ করা হলেও অভিযুক্তদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি দিয়েছেন সিন্ডিকেট সদস্য ও মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন সরকার। চিঠিতে অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দেয়া শাস্তি ‘মাত্রাতিরিক্ত’ এবং তা সিন্ডিকেট কর্তৃক পুনঃবিবেচনা করতে বলেছেন।
যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের পক্ষে সাফাই গেয়ে তিনি শিক্ষকতার নৈতিক ভিত্তি ক্ষুণ্ন করেছেন—এমন মন্তব্য করেছেন একাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী। তাদের দাবি, এ ধরনের অবস্থান সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে তাঁর উপযুক্ততা নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
জানা যায়, ২০২০ সালে ইংরেজি বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে তৎকালীন বিভাগীয় চেয়ারম্যান আলী রেজওয়ান তালুকদারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ওঠে, তার অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়া এবং ঐসকল বিষয়ে তথ্য ফোনে থাকায় পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীর ফোনের সিমকার্ড পরিবর্তন ও মেমোরি নষ্ট করে ফেলেন। অভিযোগকারী দাবি করেন, শিক্ষক আলী রেজওয়ান আগেও তাকে বিভিন্ন সময় নিজের কক্ষে বা বাসায় আসার প্রস্তাব দিয়েছেন এবং ক্লাসে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন।
অন্যদিকে, মো. জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একাধিক অভিযোগ ওঠে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, তিনি বিবাহিত নারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ করে ক্লাসে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করেন। এক শিক্ষার্থীকে বলেন, “জামাইয়ের সাথে থাকতে থাকতে বালতি হয়ে গেছো।” আবার ঢাকায় থাকার কারণে এক শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকায় তাকে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে বলেন, “তুমি ঢাকা ছিলা, তোমাকে খুললো কে?”
এছাড়া, ২০২২ সালের ২১ আগস্ট বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের চতুর্থ সেমিস্টারের ‘বিজনেস স্ট্যাটিস্টিকস’ কোর্সের ভাইভা চলাকালে এক ছাত্রী পর্দা করায় তাকে ‘মৌলবাদী জঙ্গি’ বলে আখ্যায়িত করেন জসিম উদ্দিন। সেই শিক্ষার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় ‘ম্যানার’ না জানার অজুহাতে অপমানও করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসকল অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট সাপেক্ষে এবং সিন্ডিকেট সভায় আলোচনার মাধ্যমে অভিযুক্ত দুই শিক্ষককে সম্প্রতি শাস্তিস্বরূপ পদাবনতি দেওয়া হয়।
তবে সম্প্রতি রেজিস্ট্রার দপ্তরে জমা দেওয়া চিঠিতে যৌন হয়রানির অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের পক্ষে সাফাই গেয়ে রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি দিয়েছেন আমজাদ। তিনি চিঠিতে বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট সভায় যে শাস্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা ‘মাত্রাতিরিক্ত’ এবং কিছু শাস্তির বিষয়ে সিন্ডিকেটে আলোচনা হয় নি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অনেকেই তাঁর এই অবস্থানকে যৌন হয়রানিকে আড়াল দেওয়ার স্পষ্ট প্রয়াস হিসেবে দেখছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন সিন্ডিকেট সদস্য হয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্তদের পক্ষে কথা বলা যেমন অনৈতিক, তেমনি এটি ভুক্তভোগীদের প্রতি চরম অসম্মান। এছাড়াও তিনি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও সিন্ডিকেট সিদ্ধান্তকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
জানা যায়, গত ২৫ জুন রেজিস্ট্রার বরাবর আমজাদ হোসেন একটি চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ১০৩তম সিন্ডিকেট সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং সেখানে আলোচ্যসূচী-২৭ ও ৩১-এর অধীনে যথাক্রমে ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আলী রেজওয়ান তালুকদার এবং ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তা নিয়ে তাঁর আপত্তি রয়েছে। তাঁর দাবি, তদন্ত প্রতিবেদন সম্পূর্ণভাবে সভায় পঠিত হয়নি এবং কিছু শাস্তির বিষয়ে সভায় কোনো আলোচনাও হয়নি।
তবে সিন্ডিকেটের একাধিক সদস্য বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের ভাষ্য, সিন্ডিকেটে যে-সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তা তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই নেয়া হয়েছে এবং এ বিষয়ে সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে নেয়া হয়নি, বরং সব সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে।
এ বিষয়ে সিন্ডিকেট সদস্য ও উপ-উপাচার্য ড. মাসুদা কামাল বলেন, সাধারণত সিন্ডিকেট সভায় পর্যালোচনা ও মতামতে মাধ্যমেই যে কোনো সিদ্ধান্ত আসে। সেই অনুযায়ী অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের বিষয়েও পর্যালোচনার মাধ্যমে শাস্তির সিদ্ধান্ত এসেছে। সিন্ডিকেট সদস্য ও প্রক্টর আব্দুল হাকিম বলেন, আমি সিন্ডিকেট সভয় উপস্থিত ছিলাম। আর সকল সিন্ডিকেট সদস্যদের মতামত ও পর্যালোচনার মাধ্যমেই তাদের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে।
চিঠিতে আমজাদ হোসেন আরো লিখেছেন, অভিযুক্ত আলী রেজওয়ান তালুকদারের বিরুদ্ধে আনীত মোবাইল সিম ও মেমোরি কার্ড অপসারণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি এবং যৌন হয়রানির প্রমাণও যথেষ্ট নয়। একইভাবে, জসিম উদ্দিনের ক্ষেত্রেও যৌন হয়রানি প্রমাণিত হয়নি। চিঠিতে আমজাদ হোসেন যৌন হয়রানির পাশাপাশি বডি শেমিং-এর অভিযোগকে হালকাভাবে দেখেছেন বলেও দেখা গেছে। তিনি লেখেন, “শুধুমাত্র পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে অসতর্কতা ও বডি শেমিং এর কিছু লক্ষণ পাওয়া গেছে। এ প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি তাঁকে যে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তা মাত্রাতিরিক্ত।” এ বক্তব্যকে অনেকেই বডি শেমিং এবং যৌন হয়রানির গুরুত্ব খাটো করার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন।
সিন্ডিকেট সদস্য ও একজন শিক্ষক হয়ে যৌন হয়রানির মত কাজকের পক্ষে সাফাই গাওয়া ও প্রকাশ্য অবস্থান নেওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার সংগঠন “সোচ্চার স্টুডেন্ট’স নেটওয়ার্ক, কুবি”র সভাপতি নাইমুর রহমান ভূইয়া বলেন, একজন সিন্ডিকেট সদস্য হয়ে যৌন হয়রানির পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করার চেষ্টা করা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও শিক্ষার্থীদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।” তিনি আরও বলেন, “বডি শেমিংকে কেউ যদি গুরুতর অপরাধ মনে না করেন, তবে সেটি তার চিন্তার দীনতার প্রকাশ করে। এই মানসিকতা থেকেই যৌন হয়রানিকে হালকাভাবে দেখার সংস্কৃতি জন্ম নেয়। আমরা আশা রাখি সিন্ডিকেট ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় অনড় থাকবে”
আইন বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক বলেন, ‘শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির ঘটনা অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক একটি ‘ফিডুশিয়ারি রিলেশন’ বা আস্থাভিত্তিক সম্পর্কের অন্তর্ভুক্ত, যেখানে ‘অযৌক্তিক প্রভাব’ (Undue Influence) প্রয়োগ করা অন্যায়। এ ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অপরাধীর সামাজিক অবস্থান, চরিত্র এবং পেশাগত দায়বদ্ধতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাধারণত নিজেদের সবচেয়ে নিরাপদ মনে করে তাদের শিক্ষকদের ছায়াতলে। কিন্তু সেই শিক্ষকের কাছ থেকেই যদি কোনো অনৈতিক ও অপরাধমূলক আচরণ আসে, তা হলে তা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমন অপরাধকে কেউ যদি এই যুক্তিতে ছোট করে দেখায় যে শিক্ষার্থীকে ‘বডি শেমিং’ করা তেমন বড় অপরাধ না, তাহলে তিনি অন্যায়কে সমর্থন করছেন। শিক্ষার্থীদের জীবনে শিক্ষক হচ্ছেন একজন অভিভাবকের মতো।’
ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম শরিফুল করীম বলেন, বডি শেমিং ও যৌন হয়রানি, এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ তা করে থাকলে অবশ্যই শাস্তি পাবে। আর এটার পক্ষ কেউ নিয়ে থাকলে কোন ভিত্তিতে নিয়েছে তার উপর নির্ভর করে তা ঠিক কি ঠিক না।
এ বিষয়ে যৌন হয়রানি সেলের সদস্য সচিব শারমিন রেজোয়ানা বলেন, “বডি শেমিং করা কিংবা যৌন হয়রানি মূলক যে কোন উক্তি করাও যৌন হয়রানির আওতায় পড়ে। এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দেওয়া আছে।”
যৌন হয়রানির পক্ষ নিয়ে কথা বলার বিষয়ে তিনি বলেন, “সবাই নিজেদের ব্যক্তিগত মতামত দিতে পারেন। তবে যৌন হয়রানির মত এমন বিষয়ে পক্ষ নেওয়া নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না।”
যৌন হয়রানির পক্ষ নিয়ে চিঠি দেওয়া নিয়ে আমজাদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান এবং প্রতিবেদকের ফোন কেটে দেন।