১০:৪০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে শরীয়তপুরের উল্লাস পাল এখন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে উল্লাস পাল আজ প্রশাসন  ক্যাডার। জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছিল তার সঙ্গী, কিন্তু তাতেই তার স্বপ্ন থেমে থাকেনি। বরং জীবনের প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি ব্যথা আর বাধাকে শক্তিতে রূপান্তর করে এগিয়ে গেছেন নিজের লক্ষে।

জানা গেছে, উল্লাস পালের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের কার্তিকপুর গ্রামে। বাবা উত্তম কুমার পাল একজন মৃৎশিল্পী, আর মা আন্না রানী পাল গৃহিণী। তিন ভাইবোনের মধ্যে উল্লাস পাল বড়। জন্ম থেকেই তার দুই হাত-পা বাঁকা ছিল। শিশুকালে স্বাভাবিকভাবে হাঁটা শেখেননি।

কষ্টে জীবন যাপন করলেও তাকে ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করানোর সিধান্ত নেয় তার পরিবার।  একটি পায়ের অপারেশনের মাধ্যমে কিছুটা হাঁটাচলার উপযোগী হলেও তা ছিল ভিন্নধর্মী ও কষ্টসাধ্য। কিন্তু তার পরেও থেমে যায়নি উল্লাস পাল।
১৯৯৯ সালে ভর্তি হন কার্তিকপুর পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বর্ষায় কাদামাটি মারিয়ে স্কুলে যাওয়া ছিল খুবই অসুবিধার, তখন বাবাই তাকে কোলে পিঠে তুলে নিয়ে যেতেন স্কুলে। বা হাতে লেখা ছিল উল্লাস পলের অভ্যাস।

২০১০ সালে শরীয়তপুরেরর্র নড়িয় উপজেলার কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। ঢাকায় উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির জন্য  সুযোগ হয় ঢাকা নর্দান কলেজে,  সেখান থেকে ২০১২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হন ২০১৬ সালে, সেখান থেকে বিবিএ এবং পরে এমবিএ সম্পন্ন করেন।

উল্লাসের স্বপ্ন ছিলো বিসিএস ক্যাডার হওয়া। এর পরে শুরু করেন অক্লান্ত পরিশ্রম আর কঠোর প্রস্তুতি। ৪০তম, ৪১তম ও ৪৩তম বিসিএসে অংশ নেন। ৪০তম পাস করেও কোনো পদ পাননি, ৪১তম বিসিএসে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে সুপারিশ পান।  এর পরে ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন নড়িয়া সরকারি কলেজে। কিন্তু তবু তিনি থেমে থাকেননি, তার স্বপ্ন ছিল প্রশাসন ক্যাডার হওয়া। সেই স্বপ্ন পূরণে ৪৪তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করেন। যেখানে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন।
এলাকাবাসী জানান, উল্লাস পাল শিখিয়েছে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কিছুই নয়, যদি মনের মধ্যে থাকে অদম্য ইচ্ছাশক্তি। তার মতো একজন তরুণ আজ এক নতুন প্রজন্মের আলোর পথ দেখাচ্ছেন।

উল্লাস পালের মা আন্না রানী পাল বলেন, ছেলেটা ছোট থেকেই সংগ্রাম করে বড় হয়েছে। আমরা খুব কষ্ট করে ওকে বড় করেছি। আজ সে প্রশাসন ক্যাডারে হয়েছে, গর্বে বুক ভরে উঠেছে।
বাবা উত্তম কুমার পাল বলেন, ওর লেখাপড়ার প্রতি ভালোবাসা দেখে আমরা সব সময় তাকে সাহস দিয়েছি। আজ সেই সাহস ওর জীবনে আলো এনে দিয়েছে।
উল্লাস পাল বলেন, যখন নিজের রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রশাসন ক্যাডারে মিলিয়ে নিশ্চিত হলাম চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। অনেকেই আমাকে উপহাস করেছে, বলেছে পারব না। আমি দমে যাইনি। আমার স্বপ্ন ছিল প্রশাসন ক্যাডার, আজ সেটা সত্যি হলো।

উল্লাস আরো বলেন, শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা কোনো অভিশাপ নয়। সমাজ একটু পাশে থাকলেই তারাও এগিয়ে যেতে পারে। আমি চাই, সমাজ যেন তাদের দিকে করুণা নয়, সম্মান নিয়েই তাকায়।
কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. হারুন অর রশিদ বলেন, শারীরিকভাবে একটু সমস্যা ছিল, কিন্তু মেধায় দুর্দান্ত সে। ওর এই সাফল্যে আমি খুবই আনন্দিত।

ট্যাগঃ
প্রতিনিধির তথ্য

জনপ্রিয় পোস্ট

নবাগত শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখর খুবি ক্যাম্পাস

শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে শরীয়তপুরের উল্লাস পাল এখন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার

পোস্ট হয়েছেঃ ০৯:১১:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে উল্লাস পাল আজ প্রশাসন  ক্যাডার। জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছিল তার সঙ্গী, কিন্তু তাতেই তার স্বপ্ন থেমে থাকেনি। বরং জীবনের প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি ব্যথা আর বাধাকে শক্তিতে রূপান্তর করে এগিয়ে গেছেন নিজের লক্ষে।

জানা গেছে, উল্লাস পালের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের কার্তিকপুর গ্রামে। বাবা উত্তম কুমার পাল একজন মৃৎশিল্পী, আর মা আন্না রানী পাল গৃহিণী। তিন ভাইবোনের মধ্যে উল্লাস পাল বড়। জন্ম থেকেই তার দুই হাত-পা বাঁকা ছিল। শিশুকালে স্বাভাবিকভাবে হাঁটা শেখেননি।

কষ্টে জীবন যাপন করলেও তাকে ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করানোর সিধান্ত নেয় তার পরিবার।  একটি পায়ের অপারেশনের মাধ্যমে কিছুটা হাঁটাচলার উপযোগী হলেও তা ছিল ভিন্নধর্মী ও কষ্টসাধ্য। কিন্তু তার পরেও থেমে যায়নি উল্লাস পাল।
১৯৯৯ সালে ভর্তি হন কার্তিকপুর পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বর্ষায় কাদামাটি মারিয়ে স্কুলে যাওয়া ছিল খুবই অসুবিধার, তখন বাবাই তাকে কোলে পিঠে তুলে নিয়ে যেতেন স্কুলে। বা হাতে লেখা ছিল উল্লাস পলের অভ্যাস।

২০১০ সালে শরীয়তপুরেরর্র নড়িয় উপজেলার কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। ঢাকায় উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির জন্য  সুযোগ হয় ঢাকা নর্দান কলেজে,  সেখান থেকে ২০১২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হন ২০১৬ সালে, সেখান থেকে বিবিএ এবং পরে এমবিএ সম্পন্ন করেন।

উল্লাসের স্বপ্ন ছিলো বিসিএস ক্যাডার হওয়া। এর পরে শুরু করেন অক্লান্ত পরিশ্রম আর কঠোর প্রস্তুতি। ৪০তম, ৪১তম ও ৪৩তম বিসিএসে অংশ নেন। ৪০তম পাস করেও কোনো পদ পাননি, ৪১তম বিসিএসে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে সুপারিশ পান।  এর পরে ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন নড়িয়া সরকারি কলেজে। কিন্তু তবু তিনি থেমে থাকেননি, তার স্বপ্ন ছিল প্রশাসন ক্যাডার হওয়া। সেই স্বপ্ন পূরণে ৪৪তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করেন। যেখানে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন।
এলাকাবাসী জানান, উল্লাস পাল শিখিয়েছে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কিছুই নয়, যদি মনের মধ্যে থাকে অদম্য ইচ্ছাশক্তি। তার মতো একজন তরুণ আজ এক নতুন প্রজন্মের আলোর পথ দেখাচ্ছেন।

উল্লাস পালের মা আন্না রানী পাল বলেন, ছেলেটা ছোট থেকেই সংগ্রাম করে বড় হয়েছে। আমরা খুব কষ্ট করে ওকে বড় করেছি। আজ সে প্রশাসন ক্যাডারে হয়েছে, গর্বে বুক ভরে উঠেছে।
বাবা উত্তম কুমার পাল বলেন, ওর লেখাপড়ার প্রতি ভালোবাসা দেখে আমরা সব সময় তাকে সাহস দিয়েছি। আজ সেই সাহস ওর জীবনে আলো এনে দিয়েছে।
উল্লাস পাল বলেন, যখন নিজের রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রশাসন ক্যাডারে মিলিয়ে নিশ্চিত হলাম চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। অনেকেই আমাকে উপহাস করেছে, বলেছে পারব না। আমি দমে যাইনি। আমার স্বপ্ন ছিল প্রশাসন ক্যাডার, আজ সেটা সত্যি হলো।

উল্লাস আরো বলেন, শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা কোনো অভিশাপ নয়। সমাজ একটু পাশে থাকলেই তারাও এগিয়ে যেতে পারে। আমি চাই, সমাজ যেন তাদের দিকে করুণা নয়, সম্মান নিয়েই তাকায়।
কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. হারুন অর রশিদ বলেন, শারীরিকভাবে একটু সমস্যা ছিল, কিন্তু মেধায় দুর্দান্ত সে। ওর এই সাফল্যে আমি খুবই আনন্দিত।