০২:৪৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কালীগঞ্জে কোটি টাকার শিশু হাসপাতাল পড়ে আছে অচল জনবল সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে নির্মিত চার কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি এখন কার্যত পরিত্যক্ত। কোঁটচাঁদপুর—চুয়াডাঙ্গা মহাসড়কের পাশে, মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশনের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এই আধুনিক ভবনটি কোনো এক সময় ছিল এলাকার মানুষের স্বপ্ন। মাতৃমৃত্যু হ্রাস, শিশুরোগের উন্নত চিকিৎসা ও নিরাপদ প্রসবের লক্ষ্য নিয়ে ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় হাসপাতালটি।
কিন্তু উদ্বোধনের কয়েক মাসের মধ্যেই সেটি হারিয়ে ফেলে কার্যকারিতা। নেই চিকিৎসক, নেই নার্স, নেই পর্যাপ্ত স্টাফ। জনবল সংকটে পড়ে হাসপাতালটি এখন কার্যত অচল। ধুলায় ঢেকে যাচ্ছে অপারেশন থিয়েটার, অকেজো হয়ে যাচ্ছে যন্ত্রপাতি, ফাঁকা পড়ে আছে ওয়ার্ড ও বেড পানির লইন সবই অচল হয়ে গেছে।
চিকিৎসার আশায় এসে ফিরে যান
প্রতিদিন গর্ভবতী নারীসহ মা ও শিশুরা স্বাস্থ্যসেবার আশায় আসেন। কেউ আসেন প্রসবজনিত জটিলতা নিয়ে, কেউ মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্ডের আশায়। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসক না থাকায় হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়। স্থানীয় রাবেয়া খাতুন বলেন, “প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসে। কিন্তু চিকিৎসক নেই, কেউ দেখেও না। আমরা গরিব মানুষ, এত দূরে উপজেলা হাসপাতালে যাওয়া কষ্টকর।”
জনবল কাঠামো নেই, সেবা নেই
সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী এখানে ১২ জন জনবল থাকার কথা—যার মধ্যে ২ জন চিকিৎসক, ১ জন ল্যাব টেকনিশিয়ান, ১ জন ফার্মাসিস্ট, ১ জন আয়া, ১ জন ওয়ার্ডবয়, ১ জন এফডব্লিউভি, ৪ জন অফিস সহায়কসহ আরও কয়েকটি পদ রয়েছে। বাস্তবে কর্মরত আছেন মাত্র ৪ জন।
এই ৪ জনের মধ্যে একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি) অঞ্জলী রানী খাঁ—যিনি সার্বক্ষণিক থেকে প্রায় একাই প্রতিষ্ঠানটি আগলে রেখেছেন। তাঁর সঙ্গে সপ্তাহে তিন দিন এসে সহযোগিতা করেন উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. কামাল হোসেন তিনিও অত্যন্ত আন্তরিক এই প্রতিষ্টানটি সুষ্টুভাবে পরিচালনার জন্য সিদ্ধহস্ত।
‘২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা’ কেবল বোর্ডে
হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা’। কিন্তু সেটি বাস্তবে নেই। আসা রোগীদের রেজিস্টারে নাম লেখানোর পর জানিয়ে দেওয়া হয়—চিকিৎসক নেই, অন্য হাসপাতালে যান। ওষুধ নেই, অপারেশন থিয়েটার বন্ধ, পানির লাইন পর্যন্ত অকেজো। যন্ত্রপাতি পড়েই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নাসরিন সুলতানা ইত্তেফাককে বলেন, “হাসপাতালটি ভৌগোলিকভাবে চমৎকার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা চাই, এটি সম্পূর্ণভাবে সচল হোক। কিন্তু জনবল না থাকায় নিয়মিত সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। তারপরও আমাদের সীমিত সামর্থ্যে কিছুটা সেবা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।”
চিকিৎসক ডা. কামাল হোসেন বলেন, “এই হাসপাতালে যদি পূর্ণাঙ্গ জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে উন্নতমানের মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। কারণ অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতির দিক দিয়ে হাসপাতালটি বেশ ভালো।” আমরা কোরবানীর ঈদের ছুটিতে হাসপাতালের ষ্টাফদের ছুটি বাতিল করে ২৪ ঘন্টা সেবা অব্যাহত রেখেছিলাম।
জনপ্রতিনিধির ক্ষোভ
কালীগঞ্জ পৌরসভার সংশ্লিষ্ট ওয়াডের সাবেক কাউন্সিলর মোশারেফ হোসেন মোশা বলেন,
“অনেকবার চিঠি দিয়েছি, দাবি তুলেছি—কমপক্ষে একজন মহিলা চিকিৎসক নিয়োগের জন্য। কিন্তু আজও কোনো ফল নেই। এত বড় হাসপাতাল পড়ে আছে নিষ্ক্রিয় অবস্থায়। এটা জনগণের সঙ্গে অবিচার।”
জনগণের দাবি
এলাকাবাসী বলছেন— কেবল ভবন নির্মাণ করে দায়িত্ব শেষ নয়। সরকারের উচিত নিয়মিত মনিটরিং এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। অবিলম্বে জনবল নিয়োগ দিয়ে হাসপাতালটি চালু করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এক নজরে হাসপাতালের চিত্র:
✅ ২০২২ সালে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত
✅ ১০ শয্যার আধুনিক ভবন ও অপারেশন থিয়েটার
✅ নিয়মিত চিকিৎসক নেই, সপ্তাহে ১—৩ দিন ক্যাম্প
✅ অনুমোদিত ১২ জন জনবলে কর্মরত মাত্র ৪ জন
✅ চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অবকাঠামো নষ্টের পথে
✅ এলাকাবাসীর দাবি—জনবল নিয়োগ দিয়ে হাসপাতাল সচল করুন
এই হাসপাতাল হতে পারত দক্ষিণাঞ্চলের একটি রোল মডেল। কিন্তু আজ সেটি দাঁড়িয়ে আছে এক নীরব, অনাদৃত সরকারি স্বপ্ন হয়ে। জনগণের করের টাকায় নির্মিত এই প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে এখনই প্রয়োজন সাহসী ও কার্যকর পদক্ষেপ
ট্যাগঃ
প্রতিনিধির তথ্য

জনপ্রিয় পোস্ট

শৈলকুপায় জমি দখল নিয়ে দাদাগিরি! পরিবারের রাস্তা বন্ধ করে অবরুদ্ধ

কালীগঞ্জে কোটি টাকার শিশু হাসপাতাল পড়ে আছে অচল জনবল সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প

পোস্ট হয়েছেঃ ১১:২৯:৪৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ জুলাই ২০২৫
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে নির্মিত চার কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রটি এখন কার্যত পরিত্যক্ত। কোঁটচাঁদপুর—চুয়াডাঙ্গা মহাসড়কের পাশে, মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশনের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এই আধুনিক ভবনটি কোনো এক সময় ছিল এলাকার মানুষের স্বপ্ন। মাতৃমৃত্যু হ্রাস, শিশুরোগের উন্নত চিকিৎসা ও নিরাপদ প্রসবের লক্ষ্য নিয়ে ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় হাসপাতালটি।
কিন্তু উদ্বোধনের কয়েক মাসের মধ্যেই সেটি হারিয়ে ফেলে কার্যকারিতা। নেই চিকিৎসক, নেই নার্স, নেই পর্যাপ্ত স্টাফ। জনবল সংকটে পড়ে হাসপাতালটি এখন কার্যত অচল। ধুলায় ঢেকে যাচ্ছে অপারেশন থিয়েটার, অকেজো হয়ে যাচ্ছে যন্ত্রপাতি, ফাঁকা পড়ে আছে ওয়ার্ড ও বেড পানির লইন সবই অচল হয়ে গেছে।
চিকিৎসার আশায় এসে ফিরে যান
প্রতিদিন গর্ভবতী নারীসহ মা ও শিশুরা স্বাস্থ্যসেবার আশায় আসেন। কেউ আসেন প্রসবজনিত জটিলতা নিয়ে, কেউ মাতৃত্বকালীন ভাতা কার্ডের আশায়। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসক না থাকায় হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়। স্থানীয় রাবেয়া খাতুন বলেন, “প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসে। কিন্তু চিকিৎসক নেই, কেউ দেখেও না। আমরা গরিব মানুষ, এত দূরে উপজেলা হাসপাতালে যাওয়া কষ্টকর।”
জনবল কাঠামো নেই, সেবা নেই
সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী এখানে ১২ জন জনবল থাকার কথা—যার মধ্যে ২ জন চিকিৎসক, ১ জন ল্যাব টেকনিশিয়ান, ১ জন ফার্মাসিস্ট, ১ জন আয়া, ১ জন ওয়ার্ডবয়, ১ জন এফডব্লিউভি, ৪ জন অফিস সহায়কসহ আরও কয়েকটি পদ রয়েছে। বাস্তবে কর্মরত আছেন মাত্র ৪ জন।
এই ৪ জনের মধ্যে একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি) অঞ্জলী রানী খাঁ—যিনি সার্বক্ষণিক থেকে প্রায় একাই প্রতিষ্ঠানটি আগলে রেখেছেন। তাঁর সঙ্গে সপ্তাহে তিন দিন এসে সহযোগিতা করেন উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. কামাল হোসেন তিনিও অত্যন্ত আন্তরিক এই প্রতিষ্টানটি সুষ্টুভাবে পরিচালনার জন্য সিদ্ধহস্ত।
‘২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা’ কেবল বোর্ডে
হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা’। কিন্তু সেটি বাস্তবে নেই। আসা রোগীদের রেজিস্টারে নাম লেখানোর পর জানিয়ে দেওয়া হয়—চিকিৎসক নেই, অন্য হাসপাতালে যান। ওষুধ নেই, অপারেশন থিয়েটার বন্ধ, পানির লাইন পর্যন্ত অকেজো। যন্ত্রপাতি পড়েই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নাসরিন সুলতানা ইত্তেফাককে বলেন, “হাসপাতালটি ভৌগোলিকভাবে চমৎকার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা চাই, এটি সম্পূর্ণভাবে সচল হোক। কিন্তু জনবল না থাকায় নিয়মিত সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। তারপরও আমাদের সীমিত সামর্থ্যে কিছুটা সেবা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।”
চিকিৎসক ডা. কামাল হোসেন বলেন, “এই হাসপাতালে যদি পূর্ণাঙ্গ জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে উন্নতমানের মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। কারণ অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতির দিক দিয়ে হাসপাতালটি বেশ ভালো।” আমরা কোরবানীর ঈদের ছুটিতে হাসপাতালের ষ্টাফদের ছুটি বাতিল করে ২৪ ঘন্টা সেবা অব্যাহত রেখেছিলাম।
জনপ্রতিনিধির ক্ষোভ
কালীগঞ্জ পৌরসভার সংশ্লিষ্ট ওয়াডের সাবেক কাউন্সিলর মোশারেফ হোসেন মোশা বলেন,
“অনেকবার চিঠি দিয়েছি, দাবি তুলেছি—কমপক্ষে একজন মহিলা চিকিৎসক নিয়োগের জন্য। কিন্তু আজও কোনো ফল নেই। এত বড় হাসপাতাল পড়ে আছে নিষ্ক্রিয় অবস্থায়। এটা জনগণের সঙ্গে অবিচার।”
জনগণের দাবি
এলাকাবাসী বলছেন— কেবল ভবন নির্মাণ করে দায়িত্ব শেষ নয়। সরকারের উচিত নিয়মিত মনিটরিং এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। অবিলম্বে জনবল নিয়োগ দিয়ে হাসপাতালটি চালু করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এক নজরে হাসপাতালের চিত্র:
✅ ২০২২ সালে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত
✅ ১০ শয্যার আধুনিক ভবন ও অপারেশন থিয়েটার
✅ নিয়মিত চিকিৎসক নেই, সপ্তাহে ১—৩ দিন ক্যাম্প
✅ অনুমোদিত ১২ জন জনবলে কর্মরত মাত্র ৪ জন
✅ চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অবকাঠামো নষ্টের পথে
✅ এলাকাবাসীর দাবি—জনবল নিয়োগ দিয়ে হাসপাতাল সচল করুন
এই হাসপাতাল হতে পারত দক্ষিণাঞ্চলের একটি রোল মডেল। কিন্তু আজ সেটি দাঁড়িয়ে আছে এক নীরব, অনাদৃত সরকারি স্বপ্ন হয়ে। জনগণের করের টাকায় নির্মিত এই প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে এখনই প্রয়োজন সাহসী ও কার্যকর পদক্ষেপ