০৬:২২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সংগ্রামী কৃষক সাহেব আলী’র অবিশ্বাস্য যাত্রায় সন্তানদের বর্ণাঢ্য জীবন

  • Miah Suleman
  • পোস্ট হয়েছেঃ ০৭:২৮:১০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
  • 226
“যেখানে জমি ফসল দেয়, সেখানেই যদি মন চাষ হয়—ফলে ওঠে ভবিষ্যতের সোনালি গল্প।”
 এই কথায় যেন ঝরে পড়ে শতছিন্ন শার্টের পকেটে গুঁজে রাখা এক পিতার প্রতিজ্ঞা। এই কথাগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এক কৃষক পিতার সংগ্রামী জীবনে। তাঁর নাম মো. সাহেব আলী। তিনি শুধু একজন কৃষক নন—তিনি এক ভবিষ্যৎ নির্মাতা। মাটি চষে যিনি শুধু ফসল ফলাননি, ফসল তুলেছেন সন্তানদের স্বপ্ন থেকেও। নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়েছেন, যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর চার সন্তানকে ঘিরে গড়ে ওঠা বর্ণাঢ্য জীবনে। যিনি জানতেন—সন্তানরা একদিন সুভাগ্যের আকাশ ছুঁবে।
মাটি চষা হাতে ভবিষ্যতের চাষ
মো. সাহেব আলীর হাতে ছিল লাঙল, পায়ে ছিল কাঁটা, আর পকেটে প্রায়ই শূন্যতা। তবু তার চোখজোড়া ভরা থাকত সম্ভাবনার দীপ্ত আলোয়। একদিন ভোরবেলা জমিতে যাবার আগে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেন, ভাবতেন কোন পথে গেলে তারা পাবে আলোর দেখা। নিজেই বলেন,
“আমি জমির হাল চষি, কিন্তু ওরা যেন জীবনটা চষতে শেখে। আমি সাইন জানি না, কিন্তু ওরা যেন স্বাক্ষর হতে শেখে।” এই কথার ভেতরে লুকিয়ে আছে এক নিঃস্ব পিতার অসীম স্বপ্ন, ত্যাগ আর জেদের গল্প।
বড় ছেলে: পিতার চোখে প্রথম দীপ্তি
বড় ছেলে মো. সোলেমান মিয়া প্রথম বুঝিয়ে দেন—স্বপ্ন বড় হলে পথ তৈরি হয় নিজেরাই। স্কুল, কলেজ পেরিয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হলেও আর্থিক সংকটে থমকে যায় যায় প্রায় সব। ঠিক সেই সময় পারিবারিক আত্মীয় নীরদা রানী দাস এগিয়ে আসেন। তাঁর সহায়তায় সোলেমান মিয়া ভর্তি হন ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজের ইংরেজি বিভাগে। সাফল্যের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে পরবর্তী সময়ে NTRCA পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একজন সরকারি MPO-ভূক্ত ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তিনি নিজেই বলেন:
“কেউ একজন ত্যাগ করে, পরিবারের অন্য সদস্যকে সচল করতে।”
মেঝো ছেলে: স্বপ্নকে পুঁজি করে ব্যবসায়িক পথে
পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান মো. লোকমান মিয়া পড়াশোনা করতে পারেননি বেশি দূর। বড় ভাইয়ের পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে নিজেই শহরে পাড়ি জমান। পকেটে ছিল না কিছু, ছিল এক আকাশ অনিশ্চয়তা। প্রথমে শ্রমিক হিসেবে শুরু করলেও ধীরে ধীরে দক্ষতা অর্জন করে নিজেকে তৈরি করেন নতুন পরিচয়ে—একজন উদ্যোক্তা হিসেবে। বর্তমানে ঢাকায় তিনি সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন—শাড়ি, লুঙ্গি, থান কাপড় ও লেডিস ফ্যাশনের দোকান রয়েছে তাঁর।
তার জীবন প্রমাণ করে—”সুযোগ না পেলেও সাহস আর শ্রম থাকলে সাফল্য দূরে থাকে না।”
সবার ছোট ছেলে: সংগ্রামের আলোয় ঢাবিস্থ কলেজ-এ
পিতার ছায়ায় ভাইদের ত্যাগের সোপানেই উঠে আসে পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান শাহরিয়ার হৃদয়। স্কুল ও কলেজে ভালো ফল করে বর্তমানে পড়ছেন সরকারি তিতুমীর কলেজের বাংলা বিভাগে। গর্ব করে সবাই বলেন, হৃদয়ই হবে পরিবারের বেস্ট প্রতিনিধি।
মায়ের কণ্ঠে গর্বের স্বর— “বড় ছেলেরা তো নিজেদের স্বপ্ন ভেঙে পরিবারের স্বপ্ন বাঁচাচ্ছে। ওরা যেন অন্তত মানুষ হয়—এই কামনাই করি।”
একটি পরিবার, একটি বিপ্লব
এই পরিবার শুধু তাদের জীবন পাল্টায়নি, তারা সমাজে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সাহেব আলীর মতো হাজারো কৃষক প্রমাণ করছেন—মাটি যাঁদের পেশা, স্বপ্ন গড়াই যাঁদের ধর্ম। আর সন্তানরা সেই স্বপ্নের চাষ ফলিয়ে এগিয়ে নিচ্ছে পরিবারকে, সমাজকে, দেশকে।
ত্যাগে গড়া স্বপ্নের সিঁড়িতে উঠে BSc-তে পড়ছে ছোটবোন!
“বোন যেন পড়ে, যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। নিজেরা পিছিয়ে গেলেও ওর স্বপ্ন যেন থেমে না যায়, তাই নিজেরা থেমে থেকেছে জীবনের অনেক জায়গায়…”
এভাবেই শুরু হয় সাহেব আলী মিয়ার চতুর্থ সন্তানের, একমাত্র মেয়ের, স্বপ্নযাত্রার গল্প। এই মেয়েটির নাম জান্নাতুল জ্যোতি চাম্পা। পিতার কথা, “ভাইয়েরা পিছিয়ে গেল, মেয়ে যেন এগিয়ে যায়।” এখান থেকে বুঝা গেল, “আজ হয়তো সে-ই এই পরিবারের গর্বের সবচেয়ে দীপ্ত আলো।” তার এক ভাই চোখের জল গোপন করে বলে—
“আমরা কেউ চাইনি, ও আমাদের মতো কষ্ট করুক।”
আবেগ চেপে বোন বলে—
“আমি আজ যে জায়গায়, সেটা পরিবারের সমন্বিত প্রয়াস। তারা যদি না দিতো, আমি কিছুই পারতাম না। একদিন আমি চাকরি করবো, বাবাকে বিশ্রামে দেব, পাশে দাঁড়াব।”
এ শুধু একটি পরিবারের গল্প নয়—এটা একটি কৃষক পিতার কষ্ট, ভাইদের ত্যাগ, এবং একটি গ্রামের অন্ধকার থেকে আলোয় উঠে আসার প্রতীক।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিবারই দেশের মেরুদণ্ড। যাঁরা নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে অন্যের জন্য পথ বানান। এই পথেই হাঁটে প্রগতি, উঠে আসে আলো।বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রামীণ তরুণদের এই রকম আত্মত্যাগ আর পারিবারিক সহানুভূতির গল্প আসলে বাংলাদেশের প্রগতি ও প্রতিরোধের এক নিরব ইতিহাস। যেখানে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে সাহেব আলীর মতো আরও অনেক ‘নির্মাতা’ পিতা, এবং সম্ভাবনাময় প্রজন্ম।এই পরিবার আমাদের শেখায়—আর্থিক দারিদ্র্য মানেই নয় ভবিষ্যতের অভাব। যদি থাকে সাহসী পিতা, নিবেদিত সন্তান আর অদম্য মন, তবে গল্প হয় ঠিক এমনই—সংগ্রামের বুক চিরে উঠে আসে সোনালি রোদ।
ট্যাগঃ
প্রতিনিধির তথ্য

জনপ্রিয় পোস্ট

লাম্পিতে বিপর্যস্ত খামারিরা

সংগ্রামী কৃষক সাহেব আলী’র অবিশ্বাস্য যাত্রায় সন্তানদের বর্ণাঢ্য জীবন

পোস্ট হয়েছেঃ ০৭:২৮:১০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
“যেখানে জমি ফসল দেয়, সেখানেই যদি মন চাষ হয়—ফলে ওঠে ভবিষ্যতের সোনালি গল্প।”
 এই কথায় যেন ঝরে পড়ে শতছিন্ন শার্টের পকেটে গুঁজে রাখা এক পিতার প্রতিজ্ঞা। এই কথাগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এক কৃষক পিতার সংগ্রামী জীবনে। তাঁর নাম মো. সাহেব আলী। তিনি শুধু একজন কৃষক নন—তিনি এক ভবিষ্যৎ নির্মাতা। মাটি চষে যিনি শুধু ফসল ফলাননি, ফসল তুলেছেন সন্তানদের স্বপ্ন থেকেও। নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়েছেন, যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর চার সন্তানকে ঘিরে গড়ে ওঠা বর্ণাঢ্য জীবনে। যিনি জানতেন—সন্তানরা একদিন সুভাগ্যের আকাশ ছুঁবে।
মাটি চষা হাতে ভবিষ্যতের চাষ
মো. সাহেব আলীর হাতে ছিল লাঙল, পায়ে ছিল কাঁটা, আর পকেটে প্রায়ই শূন্যতা। তবু তার চোখজোড়া ভরা থাকত সম্ভাবনার দীপ্ত আলোয়। একদিন ভোরবেলা জমিতে যাবার আগে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেন, ভাবতেন কোন পথে গেলে তারা পাবে আলোর দেখা। নিজেই বলেন,
“আমি জমির হাল চষি, কিন্তু ওরা যেন জীবনটা চষতে শেখে। আমি সাইন জানি না, কিন্তু ওরা যেন স্বাক্ষর হতে শেখে।” এই কথার ভেতরে লুকিয়ে আছে এক নিঃস্ব পিতার অসীম স্বপ্ন, ত্যাগ আর জেদের গল্প।
বড় ছেলে: পিতার চোখে প্রথম দীপ্তি
বড় ছেলে মো. সোলেমান মিয়া প্রথম বুঝিয়ে দেন—স্বপ্ন বড় হলে পথ তৈরি হয় নিজেরাই। স্কুল, কলেজ পেরিয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হলেও আর্থিক সংকটে থমকে যায় যায় প্রায় সব। ঠিক সেই সময় পারিবারিক আত্মীয় নীরদা রানী দাস এগিয়ে আসেন। তাঁর সহায়তায় সোলেমান মিয়া ভর্তি হন ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজের ইংরেজি বিভাগে। সাফল্যের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে পরবর্তী সময়ে NTRCA পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একজন সরকারি MPO-ভূক্ত ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তিনি নিজেই বলেন:
“কেউ একজন ত্যাগ করে, পরিবারের অন্য সদস্যকে সচল করতে।”
মেঝো ছেলে: স্বপ্নকে পুঁজি করে ব্যবসায়িক পথে
পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান মো. লোকমান মিয়া পড়াশোনা করতে পারেননি বেশি দূর। বড় ভাইয়ের পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে নিজেই শহরে পাড়ি জমান। পকেটে ছিল না কিছু, ছিল এক আকাশ অনিশ্চয়তা। প্রথমে শ্রমিক হিসেবে শুরু করলেও ধীরে ধীরে দক্ষতা অর্জন করে নিজেকে তৈরি করেন নতুন পরিচয়ে—একজন উদ্যোক্তা হিসেবে। বর্তমানে ঢাকায় তিনি সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন—শাড়ি, লুঙ্গি, থান কাপড় ও লেডিস ফ্যাশনের দোকান রয়েছে তাঁর।
তার জীবন প্রমাণ করে—”সুযোগ না পেলেও সাহস আর শ্রম থাকলে সাফল্য দূরে থাকে না।”
সবার ছোট ছেলে: সংগ্রামের আলোয় ঢাবিস্থ কলেজ-এ
পিতার ছায়ায় ভাইদের ত্যাগের সোপানেই উঠে আসে পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান শাহরিয়ার হৃদয়। স্কুল ও কলেজে ভালো ফল করে বর্তমানে পড়ছেন সরকারি তিতুমীর কলেজের বাংলা বিভাগে। গর্ব করে সবাই বলেন, হৃদয়ই হবে পরিবারের বেস্ট প্রতিনিধি।
মায়ের কণ্ঠে গর্বের স্বর— “বড় ছেলেরা তো নিজেদের স্বপ্ন ভেঙে পরিবারের স্বপ্ন বাঁচাচ্ছে। ওরা যেন অন্তত মানুষ হয়—এই কামনাই করি।”
একটি পরিবার, একটি বিপ্লব
এই পরিবার শুধু তাদের জীবন পাল্টায়নি, তারা সমাজে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সাহেব আলীর মতো হাজারো কৃষক প্রমাণ করছেন—মাটি যাঁদের পেশা, স্বপ্ন গড়াই যাঁদের ধর্ম। আর সন্তানরা সেই স্বপ্নের চাষ ফলিয়ে এগিয়ে নিচ্ছে পরিবারকে, সমাজকে, দেশকে।
ত্যাগে গড়া স্বপ্নের সিঁড়িতে উঠে BSc-তে পড়ছে ছোটবোন!
“বোন যেন পড়ে, যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। নিজেরা পিছিয়ে গেলেও ওর স্বপ্ন যেন থেমে না যায়, তাই নিজেরা থেমে থেকেছে জীবনের অনেক জায়গায়…”
এভাবেই শুরু হয় সাহেব আলী মিয়ার চতুর্থ সন্তানের, একমাত্র মেয়ের, স্বপ্নযাত্রার গল্প। এই মেয়েটির নাম জান্নাতুল জ্যোতি চাম্পা। পিতার কথা, “ভাইয়েরা পিছিয়ে গেল, মেয়ে যেন এগিয়ে যায়।” এখান থেকে বুঝা গেল, “আজ হয়তো সে-ই এই পরিবারের গর্বের সবচেয়ে দীপ্ত আলো।” তার এক ভাই চোখের জল গোপন করে বলে—
“আমরা কেউ চাইনি, ও আমাদের মতো কষ্ট করুক।”
আবেগ চেপে বোন বলে—
“আমি আজ যে জায়গায়, সেটা পরিবারের সমন্বিত প্রয়াস। তারা যদি না দিতো, আমি কিছুই পারতাম না। একদিন আমি চাকরি করবো, বাবাকে বিশ্রামে দেব, পাশে দাঁড়াব।”
এ শুধু একটি পরিবারের গল্প নয়—এটা একটি কৃষক পিতার কষ্ট, ভাইদের ত্যাগ, এবং একটি গ্রামের অন্ধকার থেকে আলোয় উঠে আসার প্রতীক।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিবারই দেশের মেরুদণ্ড। যাঁরা নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে অন্যের জন্য পথ বানান। এই পথেই হাঁটে প্রগতি, উঠে আসে আলো।বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রামীণ তরুণদের এই রকম আত্মত্যাগ আর পারিবারিক সহানুভূতির গল্প আসলে বাংলাদেশের প্রগতি ও প্রতিরোধের এক নিরব ইতিহাস। যেখানে প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে সাহেব আলীর মতো আরও অনেক ‘নির্মাতা’ পিতা, এবং সম্ভাবনাময় প্রজন্ম।এই পরিবার আমাদের শেখায়—আর্থিক দারিদ্র্য মানেই নয় ভবিষ্যতের অভাব। যদি থাকে সাহসী পিতা, নিবেদিত সন্তান আর অদম্য মন, তবে গল্প হয় ঠিক এমনই—সংগ্রামের বুক চিরে উঠে আসে সোনালি রোদ।