০৬:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মতলব উত্তরে বাঁশ দিয়ে ‘গরিবের এসি’ তৈরি করে চলে সংসার

বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘরের সিলিং বেড়া চাঁদপুরের মতলব উত্তরে এখনও জনপ্রিয়তায় রয়েছে। উপজেলাজুড়ে এই হস্ত শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে ২৫-৩০ জন কারিগর৷ এই সিলিং বেড়া তৈরি করে যা আয় হয় তাই দিয়ে চলে তাদের সংসার।
আধুনিক যুগে এর ব্যবহার অনেকটা সীমিত। তবুও এই জনপদের মানুষের কাছে এর কদর রয়েছে। গ্রামের মানুষের জন্য এটি চাহিদাসম্পন্ন। বাঁশ দিয়ে তৈরি বিশেষ এই বেড়া রোদের তাপ কমিয়ে দেয়। ফলে গরমে এটি ঘর ঠান্ডা রাখতে উপযোগী। স্থানীয়ভাবে বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘরের সিলিং বেড়া (ঘরের কাড়) নামে বেশ পরিচিত। এছাড়াও এই বেড়ার উপরে অনেক জিনিসপত্র রেখে দেওয়া যায়। বিভিন্ন রকমের রং-এর আল্পনার ছোঁয়ায় এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। অনেকেই আবার এটিকে বলেন ‘গরিবের এসি’।
সিলিং ও বেড়া তৈরি করতে সাধারণত তল্লা, মুলি ও নলি বাঁশ, সুতলী, গুণা, তারকাটা, দা, সাবল, হাতুরি ও করাতের প্রয়োজন হয়। যার সবই খুব সহজে স্থানীয় বাজারে পাওয়া যায়। সেখান থেকে কিনে আনেন ওই বাঁশ শিল্পীরা। একটি মাঝাড়ি আকারের বাঁশ দিয়ে কয়েক খন্ড করে। খন্ডগুলিকে পরিমাণ মতো ফালটা দা দিয়ে ক্যাচা করতে হয়। পরে হাতুরি দিয়ে ক্যাচাগুলিকে ছেচে পাতলা করে চটা বের করা হয়।
এরপর একটি সমান জায়গায় ১০ হাত পাশ করে ৫০ থেকে ১০০ হাতের লম্বা দুটি সুতলী টানানো হয়। প্রতি এক হাত সিলিং বা বেড়া বানাতে ১২টি চটার প্রয়োজন পড়ে। ওই চটাগুলি দিয়ে শিতল পাটির মতো করে লাগিয়ে দিলেই অপরূপ বুনন কৌশল আর বাহারি কারুকাজে তৈরি হয়ে যায় এই বাহারি বাঁশের সিলিং ও বেড়া। প্রতিদিন তিনজন কারিগর ৯০ থেকে ১০০ হাত সিলিং ও বেড়া তৈরি করতে পারেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার ষাটনল ইউনিয়নের সটাকী বাজার, বাবুবাজার, মালোপাড়া এলাকায় রয়েছে এই শিল্প। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে বেড়া তৈরি। গরমে এর চাহিদা বেড়েছে। তাপ শোষণ করে তাপমাত্রা ঠিক রাখতে বাঁশের সিলিং সহায়ক। এটির তৈরির জন্য বিশেষ একধরনের বাঁশ ব্যবহার করা হয়৷ এই মলি বাঁশ আনতে হয় পাহাড়ি  এলাকা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এলাকা থেকে আনা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, সটাকী বাজার এলাকায় দীর্ঘ ৮০ বছর ধরে এই শিল্প চালু রয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফোটার আগেই শুরু হয়েছে কর্মব্যস্ততা। কেউ নতুন বেড়া বুনছেন আর কেউ রং দিচ্ছেন। আগে এখানে ১০-১৫ জন কারিগর নিয়মিত কাজ করতেন, এখন কমে এসে সংখ্যা পাঁচ। প্রতিদিন ভোরেই কাজ শুরু হয়।
সটাকী বাজার বাঁশ দিয়ে ঘরের সিলিং বেড়া তৈরির প্রধান কারিগর আব্দুল মালেক প্রধান।  তিনি ৪৭ বছর ধরে এই শিল্পের সাথে জড়িত আছেন। তার দলে রয়েছে আরও চারজন কারিগর৷ কারিগর মালেক প্রধান বলেন, এই সিলিং বেড়া তৈরি কষ্টসাধ্য। পরিশ্রম অনুযায়ী বর্তমান খুব একটা আয় থাকেনা৷ বাঁশের দাম বেড়ে গেছে। পরিবহন খরচ রয়েছে। তবুও শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রেখেছি৷ মানুষের কাছে এখনো চাহিদা আছে। বেড়ার প্রকার ভেদ অনুযায়ী দাম।
আরেক কারিগর খলিলুর রহমান জানান, এই কাজ করে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। ছোট বেলায় এই কাজ শিখেছি। আনেকেই এই কাজ ছেড়ে অন্য কাজে চলে গেছে। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করত তাহলে আমাদের কাজ করার আগ্রহ বাড়তো।
আব্দুর রহমান নামে আরেক কারিগর জানান, আমাদের খবর দিলে আমরা বাড়িতে গিয়েও কাজ করে দিয়ে আসি।
ষাটনল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফেরদাউস আলম সরকার জানান, আমার ইউনিয়নে সটাকি বাজারে দীর্ঘদিন যাবত বাঁশ দিয়ে ঘরের সিলিং বেড়া তৈরি করে আসছে। আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে তাদের সরকারি ভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করব।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা কুলসুম মনি জানান, বাংলাদেশের যে কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান লোকজীবনের সঙ্গে মিশে আছে, বাঁশ-বেত তাদের অন্যতম। সাধারণত গ্রামের লোকেরা এ হস্তশিল্পের সঙ্গে জড়িত এবং বেশির ভাগ তারাই এসব ব্যবহার করে। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি সকল সহায়তার আওতায় তাদের আনা হবে। এছাড়া বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে তাদেরকে সহায়তা করা হয়।
ট্যাগঃ
প্রতিনিধির তথ্য

জনপ্রিয় পোস্ট

লাম্পিতে বিপর্যস্ত খামারিরা

মতলব উত্তরে বাঁশ দিয়ে ‘গরিবের এসি’ তৈরি করে চলে সংসার

পোস্ট হয়েছেঃ ০৭:৪৭:৪৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘরের সিলিং বেড়া চাঁদপুরের মতলব উত্তরে এখনও জনপ্রিয়তায় রয়েছে। উপজেলাজুড়ে এই হস্ত শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে ২৫-৩০ জন কারিগর৷ এই সিলিং বেড়া তৈরি করে যা আয় হয় তাই দিয়ে চলে তাদের সংসার।
আধুনিক যুগে এর ব্যবহার অনেকটা সীমিত। তবুও এই জনপদের মানুষের কাছে এর কদর রয়েছে। গ্রামের মানুষের জন্য এটি চাহিদাসম্পন্ন। বাঁশ দিয়ে তৈরি বিশেষ এই বেড়া রোদের তাপ কমিয়ে দেয়। ফলে গরমে এটি ঘর ঠান্ডা রাখতে উপযোগী। স্থানীয়ভাবে বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘরের সিলিং বেড়া (ঘরের কাড়) নামে বেশ পরিচিত। এছাড়াও এই বেড়ার উপরে অনেক জিনিসপত্র রেখে দেওয়া যায়। বিভিন্ন রকমের রং-এর আল্পনার ছোঁয়ায় এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। অনেকেই আবার এটিকে বলেন ‘গরিবের এসি’।
সিলিং ও বেড়া তৈরি করতে সাধারণত তল্লা, মুলি ও নলি বাঁশ, সুতলী, গুণা, তারকাটা, দা, সাবল, হাতুরি ও করাতের প্রয়োজন হয়। যার সবই খুব সহজে স্থানীয় বাজারে পাওয়া যায়। সেখান থেকে কিনে আনেন ওই বাঁশ শিল্পীরা। একটি মাঝাড়ি আকারের বাঁশ দিয়ে কয়েক খন্ড করে। খন্ডগুলিকে পরিমাণ মতো ফালটা দা দিয়ে ক্যাচা করতে হয়। পরে হাতুরি দিয়ে ক্যাচাগুলিকে ছেচে পাতলা করে চটা বের করা হয়।
এরপর একটি সমান জায়গায় ১০ হাত পাশ করে ৫০ থেকে ১০০ হাতের লম্বা দুটি সুতলী টানানো হয়। প্রতি এক হাত সিলিং বা বেড়া বানাতে ১২টি চটার প্রয়োজন পড়ে। ওই চটাগুলি দিয়ে শিতল পাটির মতো করে লাগিয়ে দিলেই অপরূপ বুনন কৌশল আর বাহারি কারুকাজে তৈরি হয়ে যায় এই বাহারি বাঁশের সিলিং ও বেড়া। প্রতিদিন তিনজন কারিগর ৯০ থেকে ১০০ হাত সিলিং ও বেড়া তৈরি করতে পারেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার ষাটনল ইউনিয়নের সটাকী বাজার, বাবুবাজার, মালোপাড়া এলাকায় রয়েছে এই শিল্প। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে বেড়া তৈরি। গরমে এর চাহিদা বেড়েছে। তাপ শোষণ করে তাপমাত্রা ঠিক রাখতে বাঁশের সিলিং সহায়ক। এটির তৈরির জন্য বিশেষ একধরনের বাঁশ ব্যবহার করা হয়৷ এই মলি বাঁশ আনতে হয় পাহাড়ি  এলাকা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এলাকা থেকে আনা হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, সটাকী বাজার এলাকায় দীর্ঘ ৮০ বছর ধরে এই শিল্প চালু রয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফোটার আগেই শুরু হয়েছে কর্মব্যস্ততা। কেউ নতুন বেড়া বুনছেন আর কেউ রং দিচ্ছেন। আগে এখানে ১০-১৫ জন কারিগর নিয়মিত কাজ করতেন, এখন কমে এসে সংখ্যা পাঁচ। প্রতিদিন ভোরেই কাজ শুরু হয়।
সটাকী বাজার বাঁশ দিয়ে ঘরের সিলিং বেড়া তৈরির প্রধান কারিগর আব্দুল মালেক প্রধান।  তিনি ৪৭ বছর ধরে এই শিল্পের সাথে জড়িত আছেন। তার দলে রয়েছে আরও চারজন কারিগর৷ কারিগর মালেক প্রধান বলেন, এই সিলিং বেড়া তৈরি কষ্টসাধ্য। পরিশ্রম অনুযায়ী বর্তমান খুব একটা আয় থাকেনা৷ বাঁশের দাম বেড়ে গেছে। পরিবহন খরচ রয়েছে। তবুও শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রেখেছি৷ মানুষের কাছে এখনো চাহিদা আছে। বেড়ার প্রকার ভেদ অনুযায়ী দাম।
আরেক কারিগর খলিলুর রহমান জানান, এই কাজ করে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। ছোট বেলায় এই কাজ শিখেছি। আনেকেই এই কাজ ছেড়ে অন্য কাজে চলে গেছে। সরকার যদি আমাদের সহযোগিতা করত তাহলে আমাদের কাজ করার আগ্রহ বাড়তো।
আব্দুর রহমান নামে আরেক কারিগর জানান, আমাদের খবর দিলে আমরা বাড়িতে গিয়েও কাজ করে দিয়ে আসি।
ষাটনল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফেরদাউস আলম সরকার জানান, আমার ইউনিয়নে সটাকি বাজারে দীর্ঘদিন যাবত বাঁশ দিয়ে ঘরের সিলিং বেড়া তৈরি করে আসছে। আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে তাদের সরকারি ভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করব।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা কুলসুম মনি জানান, বাংলাদেশের যে কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান লোকজীবনের সঙ্গে মিশে আছে, বাঁশ-বেত তাদের অন্যতম। সাধারণত গ্রামের লোকেরা এ হস্তশিল্পের সঙ্গে জড়িত এবং বেশির ভাগ তারাই এসব ব্যবহার করে। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি সকল সহায়তার আওতায় তাদের আনা হবে। এছাড়া বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে তাদেরকে সহায়তা করা হয়।