
বিদ্যালয়ের আঙিনায় অদ্ভুত এক আবহ—কারও চোখে জল, কারও মুখে স্মিত হাসি। আর সবার মাঝে দাঁড়িয়ে দুজন মানুষ—যাঁদের পেছনে জড়িয়ে আছে শত স্মৃতি, স্নেহ, শিক্ষা ও শ্রদ্ধার অজস্র অধ্যায়।
কালীগঞ্জের সরকারি নলডাঙ্গা ভূষণ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবারের সকালটা ছিল অন্যরকম। এদিন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে জীবনের কর্মপর্ব শেষ করে স্মৃতির সরণিতে যাত্রা করলেন স্কুলের ইংরেজি বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক আজিবর রহমান ও অফিস সহায়ক মশিয়ার রহমান।
এ যেন কোনো গল্প নয়, রূপকথার মতো এক বিদায়।
একটি অশ্রুসজল সকাল
সকাল সাড়ে ১১টা। বিদ্যালয়ের হলরুমে আয়োজন করা হয়েছে এক স্মৃতিচারণামূলক বিদায় অনুষ্ঠানের। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও অভিভাবকদের চোখেমুখে বিষাদের ছায়া, কিন্তু গর্বিত হৃদয়ে ভালোবাসার বন্যা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. দেদারুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহীন আলম, প্রধান শিক্ষক মকবুল হোসেন তোতা, সিনিয়র শিক্ষক রুহুল আমিনসহ অনেকে মঞ্চে উঠে স্মৃতির পাতা উল্টে শুনিয়েছেন দুই বিদায়ী মানুষের গল্প।
বিদায়ী শিক্ষক বললেন—‘আমার কিছু পাওয়ার ছিল না, তবু অনেক পেয়েছি’
বিদায়ী শিক্ষক আজিবর রহমান আবেগময় কণ্ঠে বলেন,
“২১ বছরের শিক্ষকতা জীবনে কখনো ভাবিনি এমন ভালোবাসা নিয়ে বিদায় নেব। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুখ আমার হৃদয়ে গেঁথে থাকবে। যদি কোনো ভুল করে থাকি, সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।”
তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “জীবনে কিছু পেতে হলে মনোযোগ আর পরিশ্রমের বিকল্প নেই। আদর্শ মানুষ হতে হলে আগে হতে হবে ভালো ছাত্র।”
অফিস সহায়ক মশিয়ার রহমানও তাঁর কর্মময় জীবনের স্মৃতিচারণ করে সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
‘চলে যাওয়ার দিনও যেন রূপকথা হয়ে থাক’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মকবুল হোসেন তোতা বলেন,
“চাকুরি জীবনের অবসর এক নির্মম বাস্তবতা। কিন্তু এই বিদায় আমরা স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছি। তাই ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা মিশিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়ে রাজকীয়ভাবে তাদের বিদায় জানানো হয়েছে।”
বিদ্যালয়ের আঙিনায় যখন ঘোড়ার গাড়ির টং টং শব্দে বিদায়ী যাত্রা শুরু হলো, তখন শত শত শিক্ষার্থীর কণ্ঠে শুধু একটাই শব্দ—“স্যার, মনে রাখব আপনাকে…”
এমন বিদায় কোনো চাকুরিজীবনের শেষ নয়—বরং তা এক জীবনের স্বীকৃতি, এক ভালোবাসার গর্বময় উন্মোচন।

একটি বিদ্যালয়, দুটি মানুষ, আর অগণিত হৃদয়ের সম্মিলিত ভালোবাসা—এই বিদায় যেন শুধু একটি অনুষ্ঠান নয়, বরং এক মহাকাব্যিক স্মৃতি।