
বরিশালে জুলাই অভ্যুত্থানের ২০ মামলার মধ্যে মাত্র ৭ টি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছে পুলিশ।।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর বরিশাল মহানগরীর ৪ থানায় দায়ের করা ২০টি মামলার মধ্যে ৭ টিকে গুরুত্বপূর্ন হিসেবে চিহ্নিত করে কার্যক্রম চালাচ্ছে মেট্রোপলিটন পুলিশ। এ নিয়ে মামলাগুলোর বাদিসহ আইন কর্মকর্তা এবং পুলিশের বক্তব্য পরস্পর বিরোধী। ভুক্তভোগীদের মতে পুলিশের কার্যক্রমে গতি নেই।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে বরিশালের জনপদ ছিলো নিত্য উত্তাল। প্রায় প্রতিদিন তৎকালীন সরকার পক্ষের হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হতে হয়েছে পদে পদে। অভ্যুত্থান সফলের পর এসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা বরিশাল মেট্রোপলিটন ৪টি থানায় দায়ের করে ২০টি মামলা। এসব মামলায় ১৪৯৫ জনকে নামধারীসহ আসামি করা হয় ৫২৩৭ জনকে। বেশিরভাগ মামলারই বাদি হচ্ছে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মিরা। পুলিশ এসব মামলা থেকে ৭টি মামলাকে অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু এতে খুশি নয় মামলার বাদিসহ সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি পুলিশি কার্যক্রম পক্ষপাতদুষ্ট, দৃশ্যমানহীন ও ধীরগতির। তারা দ্রুত দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচার চেয়েছেন। এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মারজুক আবদুল্লাহ ও সুলতান আহমেদের দায়ের করা মামলায় পুলিশ বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে। এ মামলাগুলোও পুলিশ যাচাই-বাছাই করে আসামী গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে এসব মামলায় নিরীহ কাউকে জড়ানো হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করছে বলে পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
বরিশাল মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক আফরোজা খানম নাসরিন বলেন, আমাদের অন্যায়ভাবে ধরে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হতো। তখন আমরা ন্যায়ের পথে যুদ্ধ করেছিলাম। আমার নামে ছিলো ৫৪টি মামলা। ৯বার আমি জেল খেটেছি, নির্যাতন করে আমার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া হয়। এসব কারনে আমরা মামলা করেছি কিন্তু এসব মামলায় দৃশ্যত কোন ফল আমরা পাচ্ছিনা। যারা এতো নির্যাতন করেছে তাদের ধরে বিচারের কাঠগড়ায় নেয়া হচ্ছে না। আসামি ধরে থানায় দিলেও দুদিন পর তারা বের হয়ে যাচ্ছে। এখন পুলিশ কোন কাজ করছে না অথচ আমাদের নামে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা দিয়েছে। এখন তারা আসামিদের ধরছে না, অনেক আসামিই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশের অনিহার কারনেই অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে।
বরিশাল মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার বলেন, আমরা আমাদের প্রত্যাশার ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। এটা না হলে জনগন আসামি ধরে পুলিশে দিতো না। আমাদের মতো সারা দেশের জনগনের মধ্যেও ক্ষোভ আছে, আছে হতাশা ও রাগ থেকে সৃষ্টি হচ্ছে বেদনার। সরকার ও প্রশানের এ ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া উচিত। ভুয়া কোন মামলা আমাদের দ্বারা হয়নি। সব মামলারই প্রমান রয়েছে।
বরিশাল মহানগর বিএনপির আহবায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক বলেন, এই সরকারের কাছে আমাদের যে আশা ছিল তা পূরণ হয়নি। আজও ফ্যাসিবাদিরা ঘুরে বেয়াচ্ছে, পুলিশ কোন একশনে যাচ্ছে না। আমাদের দাবি মামলার সব আসামিকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
জেলা বিএনপির সম্পাদক আবুল কালাম শাহীন বলেন, আমরা লক্ষ করছে বিভিন্ন মামলায় ফ্যাসিবাদের আসামিরা এখনো বরিশাল নগরিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানে পুলিশি তৎপরতার ঘাটতি রয়েছে। সাথে আইনের গতি অনেক শ্লথ। আমরা আশা করি ফ্যাসিবাদ মামলার সব আ সামিরা দ্রুত গ্রেপ্তার হবে, তা না হলে এই ফ্যাসিবাদিদের শাস্তির মুখোমুখী করার জন্য আমরা আবার রাজপথে নামবো।
বরিশাল জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ বলেন, জুলাই আন্দোলনের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের এবং মদদদাতাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও কোন ধরনের প্রশাসনিক সহযোগিতা নেই যার ফলে স্বৈরাচারের দোসরা বিভিন্ন দলে আশ্রয় খুঁজছে এবং চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তিনি আরও বলেন স্বৈরাচারের সকল সন্ত্রাসী এবং মদদদাতা ও অর্থ যোগানদাতাদের অনতিবিলম্বে আইনের আওতায় আনতে হবে।
বরিশাল জেলা ছাত্র দলের সহ সভাপতি আসিফ আল মামুন বলেন, আওয়ামী লীগ আমলের সন্ত্রাসী জুলাই আন্দোলনের সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের আর্থিক যোগানদাতা রা আজও দিনের আলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং জুলাই আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে ও তারা বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অপকর্ম এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে। অথচ প্রশাসন নিরব ভূমিকা পালন করছে। ছাত্র দল এবং সাধারণ জণগণ বেশ কয়েক জন কে ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করলেও তাদের সহযোগীরা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বরিশাল মহানগর ছাত্রদল সহ সভাপতি সাকিবুল হক রাসেল বলেন, জুলাই আন্দোলনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী এবং তাদের মদদদাতাদের অতি দ্রুত আইনের আওতায় আনা না হলে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচারদের নির্দেশে দেশে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করা এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির মতো এজেন্ডা বাস্তবায়নে সফল হবে।
এদিকে গুরুত্বপূর্ণ ৭ মামলার ৭৬৫ জনকে নামধারী সহ মোট আসামি করা হয়েছে ১৯৮৭ জনকে। এদের মধ্যে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যাক৫ন, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যানসহ ৭১ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। একই সাথে আরো ১৮৯ জনকে সন্দেহজনক হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২২ জন আদালতে আত্মসমর্পন করেছে। বরিশালে যারা এসব মামলার সরকারি আইন কর্মকর্তা রয়েছেন তাদের দৃষ্টিতে মামলাগুলোর ফরোয়ার্ডিং এর ক্ষেত্রে পুলিশ আইন কর্মকর্তাদের সাথে কোন সমন্বয় করছে না। পুলিশের এমন দুর্বলতার কারনে আসামিদের জামিন হয়ে যাচ্ছে, ধরে রাখা যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে পিপি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ফ্যসিবাদের মামলাগুলোর বিষয়ে পুলিশি কার্যক্রমে অনেক নেগলেজেন্সি আছে। ফ্যাসিস্টের পতন ও তার সময়ের কার্যক্রমে পুলিশের কোন উপলব্ধি হয়নি। যদি উপলব্ধি করতো তবে বরিশালের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা নিয়ে আমাদের সাথে পুলিশের এতো দূরত্ব হতো না। আইন অনুযায়ী পুলিশ পিপির সাথে আলোচনা করবে। আমরা বারবার পুলিশকে একথা স্মরণ করিয়েছি যে বর্তমান প্রেক্ষাপটের মামলার সিডি নিয়ে পিপি মতামত নেয়া হলে আমরা তা দিতে পারতাম। কিন্তু এখন পুলিশ তা করছে না। এই না করার কারনে ৫ আগস্টের পরের মামলাগুলো নিয়ে আমি আশংকার মধ্যে আছি। পুলিশ যেভাবে একের পর এক মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দিচ্ছে, দুর্বল ত্রুটিপূর্ণ চার্জশীট দিচ্ছে যা আমাদের সংকটের মধ্যে ফেলছে। পুলিশের বর্তমান অবস্থান আমাদের জন্য শুভ নয়।
এপিপি হাফিজ আহমেদ বাবলু বলেন, বরিশালে দায়ের করা ফ্যাসিবাদ বিরোধী মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের পুলিশ এখন পর্যন্ত ধরেনি। যে ক’জন ধরা পড়েছে তাও আর্মির সহায়তায় ধরা হয়েছে। যাদের ধরে তাদের আদালতে পাঠানোর সময় দেয়া ফরওয়ার্ডিং এ এমনভাবে ফাঁক রাখা হয় যে তাদের জামিন হয়ে যায়। দায়সারা এসব ফরওয়ার্ডিং এর জন্য আমাদের কার্যক্রমও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।
তবে এ দায় নিতে পুলিশ রাজি নয়। পুলিশের বক্তব্য হলো ইতিমধ্যেই তারা একটি মামলার চার্জশীট আদালতে দায়ের করেছে। বাকিগুলোরও কার্যক্রম চলছে। এখানে ধীর গতি দেখা ঠিক নয়।
বিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের ৮টি মামলার মধ্যে একটির চার্জশীট হয়ে গেছে। অন্যগুলোর তদন্ত চলছে। ঐ সময় যে ঘটনগুলো ঘটেছে তার ভিডিও ফুটেজসহ আলামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এগুল যাচাই বাছাই করে যা সঠিক হবে তাই করা হচ্ছে। যদি কেউ বলে থাকে যে আমরা কাজ করছি না তবে সেটা ভুল। যদি কেউ বলে থাকে যে আসামি ঘুরে বেড়াচ্ছে তবে সেটা তার ব্যক্তিগত শত্রুতা। আমার জানামতে এসব মামলায় যারা জড়িত ছিলো তাদের ধরা হয়ে গেছে। খুব দ্রুত সব মামলার কার্যক্রম শেষ হবে।
উল্লেখ্য গত বছর ১৭ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনরত ৩৮শ জনের নামে দায়ের করা ১১ মামলা ইতিপূর্বে প্রত্যাহার করে নিয়েছে পুলিশ।