০৩:৫২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আ.লীগ আমলে ৪০ লাখ শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে চলে ছিনিমিনি খেলা

  • এম আয়নাল হক
  • পোস্ট হয়েছেঃ ০৯:০৫:০০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫
  • 70
দেশের উচ্চশিক্ষার ৭০ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় আড়াই হাজার কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০ লাখ শিক্ষার্থী ও লক্ষাধিক শিক্ষক নিয়ে পরিচালিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম। অথচ পতিত আওয়ামী সরকারের কালো থাবায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিশ্ববিদ্যালয়। ভয়াবহ অনিময়-দুর্নীতি, লুটপাটের পাশাপাশি এই ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থীর লেখাপড়া নিয়ে রীতিমতো ছিনিমিনি খেলা হয়। চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই ধ্বংসের মুখ থেকে ফিরে আসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিযুক্ত উপাচার্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহর নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে স্বাভাবিক গতিতে ফেরাতে চলছে নানা তৎপরতা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা বিকাশে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নের পাশাপাশি অনিয়ম-দুর্নীতির লাগাম টানতে নানা সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন বিশিষ্ট এই সমাজবিজ্ঞানী।
বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গভর্নিং বডি পরিবর্তন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করা, সিলেবাস আধুনিকায়ন, শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ৩২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপনসহ নানা সংস্কারকাজ চালাচ্ছেন তিনি। একই সঙ্গে আওয়ামী দুঃশাসনে সব দুর্নীতির অনুসন্ধান এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। আগামী ছয় মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দৃশ্যমান পরিবর্তন হবে। আমার দেশকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ এসব উদ্যোগের কথা জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।
ধ্বংসপ্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের সময়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় কেমন ক্ষতি হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, গণঅভ্যুত্থানের আগে আমাদের একটি ধারণা ছিল, শিক্ষাব্যবস্থায় একটি ঝামেলা হয়েছে এবং এক ধরনের ধস নেমেছে। কিন্তু কী ধরনের ধস নেমেছে, তা আমি বাংলাদেশের বৃহত্তম ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়-জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর দেখতে পেলাম।
তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪০ লক্ষাধিক। শিক্ষক সংখ্যাও লক্ষাধিক। ইনস্টিটিউটের সংখ্যা আড়াই হাজারের ওপরে। বিভিন্ন ক্যাটাগরির কলেজ, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটসহ বেসরকারি সব কলেজ আমাদের হাতে। আর সরকারি কলেজের একাডেমিক কার্যক্রমও আমাদের হাতে। আমরাই তাদের ডিগ্রি দিই। এতসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণকারী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোটা মোটামুটি ধ্বংস করা হয়েছে।
গভর্নিং বডির মাধ্যমে লুটপাট
উপাচার্য বলেন, গত ১৫/১৬ বছরে কলেজগুলোর গভর্নিং বডিতে এমন লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাদের কাজ বা উদ্দেশ্যই ছিল কলেজে ঢুকে লুটপাট করা। কলেজের ফান্ডগুলো যে পরিমাণ লুটপাটের শিকার হয়েছে, সেটা বের করতে অনেক সময় লাগবে। আমরা কলেজগুলোয় অডিটিং করার উদ্যোগ নিয়েছি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের নামে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে, মুজিব বর্ষের নামে ৫০ লাখ, ৭০ লাখ, ১ কোটি—এভাবে টাকা-পয়সা নিয়েছে গভর্নিং বডির সদস্যরা। গভর্নিং বডিতে কলেজ ম্যানজমেন্ট বলতে কিছু ছিল না। সব মিলিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের ধস নামে বিগত সময়ে।
ধ্বংসপ্রায় অবস্থা থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে টেনে তুলতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, শিক্ষার এই ধস নিয়ে একটা মূল্যায়ন করতে হবে। এ অবস্থা থেকে বের হতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সবখানে বিরাট ধরনের লুটপাট হয়েছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্টে দুর্নীতি হয়েছে।
তিনি বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে একটা আর্থিক তদন্ত চলছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে একটা তদন্ত রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। আমরা নামিদামি লোকদের নিয়ে একটা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি করেছি। আশা করি, আগামী (আগস্ট) মাসের মধ্যে রিপোর্ট পেয়ে যাব। সেই রিপোর্ট কম্পাইল করে যেখানে যেখানে দেওয়ার প্রয়োজন, দেওয়া হবে।
গভর্নিং বডি পরিবর্তন
উপাচার্য বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর আড়াই হাজার কলেজের গভর্নিং বডি পরিবর্তন করেছি। সেখানে আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যারিস্টারদের প্রাধান্য দিয়ে সমাজের শিক্ষিত ও নামিদামি ব্যক্তিদের রেখেছি। কোথাও কোথাও এখনো সমস্যা আছে, তবে তা ২ বা ১ শতাংশ হবে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করা
শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করার উদ্যোগ প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, আমরা কলেজে খোঁজ নিয়ে দেখলাম—ছাত্রছাত্রীরা ঠিকমতো ক্লাস করে না। এক থেকে তিন বছর ধরে অনার্সে পড়লেও ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে। এ অবস্থায় তাদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ক্লাস না করার পেছনে কারণ ছিল ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, ইনকোর্স না দিয়েও তারা পরীক্ষা দিতে পারত। আমরা বলেছি, কমপক্ষে ৬০ শতাংশ ক্লাসে অনুপস্থিতি থাকলে তাদের নন-কলেজিয়েট ঘোষণা করা হবে। এটা আগেও ছিল, তবে বাস্তবায়ন ছিল না। আমরা বাস্তবায়নে হাত দিয়েছি। এখন থেকে কলেজে যেসব ইনকোর্স এবং অ্যাসাইনমেন্ট নেওয়া হয়, তা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের পর কলেজগুলো ইনকোর্স নেওয়ার ব্যাপারে সচেতন হয়েছে। ক্লাসেও উপস্থিতির হার বেড়ে গেছে। তবে শিক্ষকদের অনুপস্থিতি বেশি দেখা যাচ্ছে। আমরা এ নিয়েও ভাবছি। শিক্ষক অনুপস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল বের করার চেষ্টা করছি।
কলেজে শিক্ষার মান খারাপের পেছনে ঘাটতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কলেজগুলোতে লাইব্রেরি থাকলেও সেখানে শিক্ষক-ছাত্র কেউ যান না। এটাকে কীভাবে কার্যকর করা যায়, কলেজে শিক্ষকদের আকর্ষণীয় করে তোলা, ছাত্র-ছাত্রীদের ফিরিয়ে আনা, তাদের ক্লাসে ধরে রাখা এবং পড়াশোনাটাকে জবাবদিহির আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
সিলেবাস সংস্কার
সিলেবাস সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম, কলেজগুলোয় অনার্স-মাস্টার্স বা গ্র্যাজুয়েশন কোর্সের নামে যা পড়ানো হচ্ছে, তার সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়ার কোনো যোগাযোগ নেই। মাঠ প্রশাসন কী চাচ্ছে, নিয়োগদাতারা কী চাচ্ছে, এদেশের সমাজ-সংস্কৃতি ও মানুষের চাহিদা কী, দেশের অর্থনীতির চাহিদা কী, বাজারের চাহিদা কী, কোনো ধরনের পড়াশোনা করলে চাকরি পাবে—সেদিকে কোনো নজর নেই। সিলেবাসগুলো অনেক পুরোনো। আমরা অনার্সের প্রায় ৩২টি সিলেবাস সংস্কারে হাত দিয়েছি। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই সংস্কারকৃত সিলেবাসে পড়াশোনা শুরু হচ্ছে। এখন যে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে, তা সংশোধিত একটি সিলেবাসের মাধ্যমে শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেও অনেকে ইংরেজি বলতে পারে না, লিখতে পারে না। এ জন্য আমরা ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছি। সব অনার্স কোর্সের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে কমিউনিকেটিভ ইংলিশ পড়তে হবে। এ জন্য আমরা আন্তর্জাতিক মানের একটি সিলেবাসও করেছি। পাশাপাশি সবার জন্য আইসিটি কোর্সকেও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। চলতি সেশন থেকেই এটি কার্যকর হচ্ছে। এতে ছেলেমেয়েদের মাঝে পড়াশোনা করার এক ধরনের উৎসাহ দেখা যাচ্ছে।
মানসম্পন্ন প্রশ্ন প্রণয়নের উদ্যোগ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন প্রণয়নে বেশ দুর্বলতা ছিল জানিয়ে উপাচার্য এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব প্রশ্ন করা হয় তার প্যাটার্ন এক। এক বছর গ্যাপ দিয়ে আরেক বছর প্রশ্ন করার এই ক্ল্যাসিক্যাল প্যাটার্ন থেকে আমরা বের হয়েছি। মডারেশন বোর্ডের সঙ্গে কথা বলে গত অনার্স এবং বিএ পরীক্ষায় প্রশ্নের ধরন মোটামুটি চেঞ্জ হয়েছে। এতে একশ্রেণির ছেলেমেয়েরা খুশি। আর যারা বই পড়ত না, গাইড বা অন্যভাবে পরীক্ষা দিত, তারা পড়াশোনায় আগ্রহী হচ্ছে।
তিনি বলেন, আগে পরীক্ষার খাতা পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা ছিল না। পুনর্নিরীক্ষণের সুযোগ ছিল। আমরা খাতা পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা করেছি। এতে অনেকেই পাস করে যাচ্ছে।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও এমপিওভুক্তির উদ্যোগ
শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও এমপিওভুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ জরুরি। কিন্তু এই ট্রেনিংয়ের তেমন ব্যবস্থা ছিল না। আমরা গত ১০ মাসে শিক্ষকদের প্রচুর ট্রেনিং শুরু করেছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য বড় বাজেট রাখা হয়েছে।
উপাচার্য বলেন, অনার্স মাস্টার্সের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষকের এমপিও ছিল না। তাদের অধিভুক্তি ছিল না। সরকারের সঙ্গে কথা বলে অনার্সের এই সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষকের এমপিওভুক্তি আদায় করতে সক্ষম হয়েছি। শিগগিরই এটা চালু হবে। আমাদের মাধ্যমে এটা একটা বড় উদ্যোগ।
তিনি বলেন, সরকারি কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতি জটিলতার সমাধানে সরকারের সঙ্গে আমাদের দেনদরবার চলছে। এ বিষয়ে সরকার ও মাউশিও কাজ করছে। আর আমাদের অধীনে এমপিওভুক্ত বেসরকারি কলেজগুলোয় শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ক্রেডিট কোর্সের উদ্যোগ
উপাচার্য আমানুল্লাহ বলেন, এটুআই এবং এনএসডিপির সঙ্গে মিলে বিশ্বের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কথা বলে অনার্সে একটা ট্রেড কোর্স চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা ১৪০ ক্রেডিটের অনার্স কোর্সের সঙ্গে ২০ ক্রেডিটের ট্রেড কোর্সও করবে। ১৪০ ক্রেডিটের কোর্সে কিছু সাবজেক্ট রিপিটেড হিসেবে শনাক্ত করেছি। সেই জায়গাগুলো থেকে একটু ড্রপ ও সমন্বয় করে প্রায় ২০ ক্রেডিটের একটা ট্রেড কোর্স চালুর চিন্তাভাবনা করেছি। এ জন্য শিক্ষার্থীরা ট্রেড কোর্সের আলাদা সার্টিফিকেট পাবে। ফ্রিল্যান্সিং, কারিগরি, ইলেট্রো মেকানিক্যাল বা সেফ হতে যে যেই ট্রেড পছন্দ করবে, সে সেটাই পড়বে। পাস করার পর তারা যাতে দেশের ভেতরে ও বাইরে অন্তত একটা চাকরি পায় অথবা উদ্যোক্তা হতে পারে। এটা কীভাবে পড়ানো হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে এ বিষয়ে সিন্ডিকেট এবং সিনেটে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে একটা হিসাব ও মডেলিংও করে দেখা গেছে বছরে যে ৭/৮ লাখ লোক বিদেশে যায়, তাদের বিরাটসংখ্যক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অথবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপ আউট হওয়া। তাদের যদি ট্রেড কোর্সের সার্টিফিকেট দিতে পারি তাহলে রেমিট্যান্স ৫০ বিলিয়ন থেকে ১০০ বিলিয়নে নিতে পারি। তাতে তার বেতন ৩০-৪০ হাজার থেকে ৬০-৭০ টাকা হবে। যেটা ভারতে, পাকিস্তানে, শ্রীলঙ্কা এমনকি নেপালেও আছে।
৩২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র হচ্ছে
৩২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথা জানিয়ে উপাচার্য বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেখান থেকে কষ্ট করে তাদের গাজীপুরে আসতে হয় বিভিন্ন কাজে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দুটি জেলা মিলিয়ে একটা আঞ্চলিক কেন্দ্র করব। ৩২টি কেন্দ্র করলে শিক্ষকদের খাতা নেওয়া ও পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার জন্য আর কষ্ট করতে হবে না। এরই মধ্যে বগুড়া এবং হবিগঞ্জে আঞ্চলিক কেন্দ্র উদ্বোধন করেছি। আগামী মাসের মধ্যে কুমিল্লা, ঝিনাইদহ ও ময়মনসিংহে আঞ্চলিক কেন্দ্র উদ্বোধন করতে যাচ্ছি। বর্তমানে আটটি আঞ্চলিক কেন্দ্র আছে। এটাকে বাড়ানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘এক্সাম ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এএমএস)’ নামে একটা সফটওয়্যার চালু করা হয়েছে। এটাকে আমরা আরো আপডেট করছি। এতে সাত-আট লাখ শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেওয়া মাত্রই তাদের হাজিরা সার্ভারে চলে আসে। এই সিস্টেমটা অটোমেশনের দিকে যাচ্ছে। আমরা ওএমআর, অত্যধিক কাগজের ব্যবহার কমানোর দিকে যাচ্ছি।
কলেজের জায়গা কাজে লাগানো
উপাচার্য জানান, কলেজগুলোয় যে জায়গা আছে, বিশেষ করে শতবর্ষী কলেজগুলোয় অনেক জায়গার অপব্যবহার হয়। এই কলেজ ক্যাম্পাসগুলোকে গ্রিন ক্যাম্পাস করা যায় কি না দেখছি। কলেজে হোম গার্ডেনিং, সোলার সিস্টেম চালু করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি
শিক্ষার মান উন্নয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা এরই মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে দক্ষতা উন্নয়নে এটুআইয়ের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছি। আমরা ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের সঙ্গেও (এনএসডিএফ) একটা চুক্তি করেছি। সেই চুক্তি অনুযায়ী আমাদের কাজও শুরু হয়েছে। সিলেবাস সংস্কার, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও গুণগত শিক্ষাবিস্তারে ইউনিসেফের সঙ্গে একটা চুক্তি হয়েছে।
ক্যারিয়ার ক্লাব প্রতিষ্ঠা
উপাচার্য বলেন, ইতোমধ্যে আমরা কলেজগুলোয় ছেলেমেয়েদের জন্য ক্যারিয়ার ক্লাব করেছি। লালমাটিয়া কলেজ দিয়ে আমরা এটা শুরু করেছি। সেখানে বিদেশি একটি সংস্থা আমাদের সাহায্য করেছে। অন্যান্য ক্লাবেও এই ক্লাব করা হচ্ছে।
নকলবিরোধী কঠোর অবস্থান
অধ্যাপক আমানুল্লাহ বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার সময় নকল একটা বড় বিষয় হিসেবে দেখা দেয়। অনার্স, মাস্টার্স, বিএড পরীক্ষায় ব্যাপক নকল হয়। এটি বন্ধে কম্বো অ্যাটাক শুরু হয়েছে। যে কারণে গত আইন পরীক্ষাটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি, সেখানে শক্ত ভূমিকা পালন করেছি। আস্তে আস্তে আমরা ল কলেজ, বিএড কলেজ, অন্যান্য ফিজিক্যাল কলেজ, পুলিশ সায়েন্স কলেজ, আনসার একাডেমি, পিআইবি, লাইব্রেরি সায়েন্স কলেজগুলোয় আমরা আধুনিকায়নের দিকে যাচ্ছি। তাদের জবাবদিহির মধ্যে আনার কাজ শুরু করেছি। সেটার ফল শিগগিরই পাওয়া যাবে। এ ব্যাপারে আমরা সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটিশসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দেশের সহযোগিতার আশ্বাস পাচ্ছি।
এমফিল-পিএইচডির স্ট্র্যাকচার পরিবর্তন
উপাচার্য বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজ শিক্ষক অথবা সমাজের অন্যান্য শ্রেণির মানুষের জন্য এমফিল-পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু আছে। সেই প্রোগ্রামের পুরো স্ট্র্যাকচার আমরা পরিবর্তন করে দিয়েছি। সেখানে এমফিল-পিএইচডি গবেষকরা প্রকৃতপক্ষে যাতে কিছু শিখতে পারেন, সেই জায়গাতে আমরা লোকজন নিয়োগ করছি।
মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলিং
তিনি বলেন, চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেই ক্ষতি থেকে বের করে আনতে আমরা সারা দেশে মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলিং শুরু করেছি। এরই মধ্যে অনেকগুলো কলেজে এই প্রোগ্রাম চালু হয়েছে। ছেলেমেয়েদের ক্লাসে ও খেলাধুলায় ফিরিয়ে আনার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস এবং কালচারাল প্রোগ্রাম আয়োজন করেছে। সামনে জাতীয় পর্যায়ে সেই অনুষ্ঠান হবে। মোটামুটি এগুলো নিয়েই এগোচ্ছি।
উচ্চশিক্ষায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ও বাস্তবতা
এ প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, বাস্তবতা খুবই খারাপ। আমাদের পরিকল্পনা হলোÑযেহেতু শিক্ষার ৭০ ভাগ শিক্ষাব্যবস্থা আমরা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করি, এটাকে একটা বিশ্বজনীন হিসেবে গড়ে তোলার আগে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শিক্ষার সঙ্গে তুলনামূলক বা তাদের সমকক্ষ হতে পারি কি না, সেই চেষ্টা চালাচ্ছি। তারপর আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ধারায় যাওয়ার চিন্তা করব।
এ জন্য শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, তাদের ট্রেনিং দেওয়া, কলেজগুলোয় আরো রিসোর্চ দেওয়া, কলেজগুলোকে জবাবদিহির ভেতরে আনা, কলেজ মনিটরিং আরো বৃদ্ধি করা, অডিটিং চালু করা, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনাকে আরো গ্রহণযোগ্য ও আগ্রহী করে তোলার কাজগুলোয় আমরা হাত দিয়েছি।
মানহীন কলেজ ও শিক্ষকদের বিষয়ে শক্ত অবস্থান
উপাচার্য বলেন, যারা একবার কলেজে ঢুকে গেছে, তাদের চট করে বের করে দেওয়া যাচ্ছে না। কলেজ গভর্নিং বডি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে, যদি শিক্ষকরা সেখানে কন্ট্রিবিউট করতে পারে, তাহলে তারা সেখানে থাকবেন আর যদি অবদান না রাখতে পারেন, খুব বেশি দলবাজির সঙ্গে যুক্ত হন, পড়াশোনার প্রতি যদি আগ্রহী না থাকেন, তাহলে গভর্নিং বডির সুপারিশ অনুযায়ী আমরা কাজ করছি।
তিনি বলেন, বিগত সময়ে যত্রতত্র অনার্স-মাস্টার্স খোলা হয়েছে। যত্রতত্র মানুষদের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে অনেক সমস্যা হয়ে গেছে। সেই জায়গাগুলো ঠিক করতে সময় লাগবে, তবে আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমরা কিছু কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের চিন্তা করছি, যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে আসবে না, তাদের বিষয়ে আমরা শক্ত ভূমিকা পালন করছি।
উন্নয়ন পরিকল্পনার দৃশ্যমান অগ্রগতি
উপাচার্য বলেন, আগামী বছরের জুনের ভেতরে আমরা প্রায় ২০টি পরীক্ষা নেব। এরই মধ্যে গত ১০ মাসে ২২টি পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। জুনের মধ্যে যদি ২০টি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সেশনজট ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক দক্ষতা, সুশাসন, গুড গভর্নেন্স নিশ্চিত করতে আমরা জিরো টলারেন্সে চলছি। এখানে কোনো ধরনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির প্রশ্রয় দিচ্ছি না। এরই মধ্যে পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে, আগামী মাস-ছয়েকের মধ্যে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। বিগত সময়ে যে ধস নেমেছিল, সেই অবস্থা থেকে তুলে আনতে হচ্ছে।
জুলাই শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ
উপাচার্য আমানুল্লাহ বলেন, দেশের উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শতকরা ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে তারা দেশের স্বার্থে অংশ নেয়, তাদের ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় ইতোমধ্যে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি শিক্ষাবৃত্তি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের শহীদ পরিবার ও আহত শিক্ষার্থীদের সব ধরনের ফি মওকুফ করা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি রক্ষায় আরো অনেক পরিকল্পনা রয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে।
শিক্ষার চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা
উপাচার্য বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে শিক্ষাব্যবস্থা চলছে, তা চতুর্থ শিল্প-বিপ্লব তো দূরের কথা, প্রথম শিল্প-বিপ্লবকেও মোকাবিলা করার মতো নয়। যুগান্তকারী তো নয়ই। দেশে অনেকগুলো শিক্ষাকমিশন হয়েছে, কিন্তু কোনোটার রিপোর্ট বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলা, ইংরেজি, ন্যাশনাল ভার্সন, উর্দু মিডিয়াম, মাদরাসাশিক্ষা, কারিগরি শিক্ষাÑসব মিলিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা একটা হযবরল অবস্থায় আছে। গত ১৫ বছরে আরো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যার জন্য আগামী ৫০ বছর বাংলাদেশকে ভুগতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের কারিকুলাম জটিলতা থেকে বের হয়ে আসতে একটা স্থায়ী শিক্ষা কমিশন লাগবে। এ জন্য আমরা জোর তদবির চালাচ্ছি। শিক্ষা খাতে যেসব মাফিয়া ও কায়েমি স্বার্থান্বেষীরা দখল করে বসে আছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে অনেক ধরনের পলিসিগত সাপোর্ট লাগবে। এ বিষয়ে সরকারকে অবগত করেছি।
তিনি বলেন, সব কলেজের শিক্ষার স্ট্যান্ডার্ড মান বজায় রাখার জন্য সরকারের পলিসি সাপোর্ট লাগবে। এ বিষয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি।
উপাচার্য বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভারত এমনকি নেপাল থেকেও পিছিয়ে আছে। আমরা এসডিজির টার্গেটগুলো অর্জন করতে পারব বলে মনে হয় না। তাই এই টার্গেট পূরণ করতে হলে এবং সত্যিকার অর্থে আমাদের একটি মধ্যম আয়ের দেশে যেতে হলে, বিশ্বে একটা মোটামুটি একটা সভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত করতে চাইলে, প্রধানত শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার ছাড়া কোনো কিছুতেই সম্ভব হবে না।
ট্যাগঃ
প্রতিনিধির তথ্য

জনপ্রিয় পোস্ট

মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ আসনে দাঁড়িপাল্লার গণজোয়ার বেড়েই চলেছে

আ.লীগ আমলে ৪০ লাখ শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে চলে ছিনিমিনি খেলা

পোস্ট হয়েছেঃ ০৯:০৫:০০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫
দেশের উচ্চশিক্ষার ৭০ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় আড়াই হাজার কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০ লাখ শিক্ষার্থী ও লক্ষাধিক শিক্ষক নিয়ে পরিচালিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম। অথচ পতিত আওয়ামী সরকারের কালো থাবায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিশ্ববিদ্যালয়। ভয়াবহ অনিময়-দুর্নীতি, লুটপাটের পাশাপাশি এই ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থীর লেখাপড়া নিয়ে রীতিমতো ছিনিমিনি খেলা হয়। চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই ধ্বংসের মুখ থেকে ফিরে আসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিযুক্ত উপাচার্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহর নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে স্বাভাবিক গতিতে ফেরাতে চলছে নানা তৎপরতা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা বিকাশে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নের পাশাপাশি অনিয়ম-দুর্নীতির লাগাম টানতে নানা সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন বিশিষ্ট এই সমাজবিজ্ঞানী।
বিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গভর্নিং বডি পরিবর্তন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করা, সিলেবাস আধুনিকায়ন, শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ৩২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপনসহ নানা সংস্কারকাজ চালাচ্ছেন তিনি। একই সঙ্গে আওয়ামী দুঃশাসনে সব দুর্নীতির অনুসন্ধান এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। আগামী ছয় মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দৃশ্যমান পরিবর্তন হবে। আমার দেশকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ এসব উদ্যোগের কথা জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।
ধ্বংসপ্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো
ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের সময়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় কেমন ক্ষতি হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, গণঅভ্যুত্থানের আগে আমাদের একটি ধারণা ছিল, শিক্ষাব্যবস্থায় একটি ঝামেলা হয়েছে এবং এক ধরনের ধস নেমেছে। কিন্তু কী ধরনের ধস নেমেছে, তা আমি বাংলাদেশের বৃহত্তম ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়-জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর দেখতে পেলাম।
তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪০ লক্ষাধিক। শিক্ষক সংখ্যাও লক্ষাধিক। ইনস্টিটিউটের সংখ্যা আড়াই হাজারের ওপরে। বিভিন্ন ক্যাটাগরির কলেজ, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটসহ বেসরকারি সব কলেজ আমাদের হাতে। আর সরকারি কলেজের একাডেমিক কার্যক্রমও আমাদের হাতে। আমরাই তাদের ডিগ্রি দিই। এতসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণকারী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোটা মোটামুটি ধ্বংস করা হয়েছে।
গভর্নিং বডির মাধ্যমে লুটপাট
উপাচার্য বলেন, গত ১৫/১৬ বছরে কলেজগুলোর গভর্নিং বডিতে এমন লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাদের কাজ বা উদ্দেশ্যই ছিল কলেজে ঢুকে লুটপাট করা। কলেজের ফান্ডগুলো যে পরিমাণ লুটপাটের শিকার হয়েছে, সেটা বের করতে অনেক সময় লাগবে। আমরা কলেজগুলোয় অডিটিং করার উদ্যোগ নিয়েছি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের নামে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে, মুজিব বর্ষের নামে ৫০ লাখ, ৭০ লাখ, ১ কোটি—এভাবে টাকা-পয়সা নিয়েছে গভর্নিং বডির সদস্যরা। গভর্নিং বডিতে কলেজ ম্যানজমেন্ট বলতে কিছু ছিল না। সব মিলিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের ধস নামে বিগত সময়ে।
ধ্বংসপ্রায় অবস্থা থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে টেনে তুলতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, শিক্ষার এই ধস নিয়ে একটা মূল্যায়ন করতে হবে। এ অবস্থা থেকে বের হতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সবখানে বিরাট ধরনের লুটপাট হয়েছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্টে দুর্নীতি হয়েছে।
তিনি বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে একটা আর্থিক তদন্ত চলছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে একটা তদন্ত রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। আমরা নামিদামি লোকদের নিয়ে একটা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি করেছি। আশা করি, আগামী (আগস্ট) মাসের মধ্যে রিপোর্ট পেয়ে যাব। সেই রিপোর্ট কম্পাইল করে যেখানে যেখানে দেওয়ার প্রয়োজন, দেওয়া হবে।
গভর্নিং বডি পরিবর্তন
উপাচার্য বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর আড়াই হাজার কলেজের গভর্নিং বডি পরিবর্তন করেছি। সেখানে আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যারিস্টারদের প্রাধান্য দিয়ে সমাজের শিক্ষিত ও নামিদামি ব্যক্তিদের রেখেছি। কোথাও কোথাও এখনো সমস্যা আছে, তবে তা ২ বা ১ শতাংশ হবে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করা
শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করার উদ্যোগ প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, আমরা কলেজে খোঁজ নিয়ে দেখলাম—ছাত্রছাত্রীরা ঠিকমতো ক্লাস করে না। এক থেকে তিন বছর ধরে অনার্সে পড়লেও ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে। এ অবস্থায় তাদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ক্লাস না করার পেছনে কারণ ছিল ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, ইনকোর্স না দিয়েও তারা পরীক্ষা দিতে পারত। আমরা বলেছি, কমপক্ষে ৬০ শতাংশ ক্লাসে অনুপস্থিতি থাকলে তাদের নন-কলেজিয়েট ঘোষণা করা হবে। এটা আগেও ছিল, তবে বাস্তবায়ন ছিল না। আমরা বাস্তবায়নে হাত দিয়েছি। এখন থেকে কলেজে যেসব ইনকোর্স এবং অ্যাসাইনমেন্ট নেওয়া হয়, তা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের পর কলেজগুলো ইনকোর্স নেওয়ার ব্যাপারে সচেতন হয়েছে। ক্লাসেও উপস্থিতির হার বেড়ে গেছে। তবে শিক্ষকদের অনুপস্থিতি বেশি দেখা যাচ্ছে। আমরা এ নিয়েও ভাবছি। শিক্ষক অনুপস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল বের করার চেষ্টা করছি।
কলেজে শিক্ষার মান খারাপের পেছনে ঘাটতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কলেজগুলোতে লাইব্রেরি থাকলেও সেখানে শিক্ষক-ছাত্র কেউ যান না। এটাকে কীভাবে কার্যকর করা যায়, কলেজে শিক্ষকদের আকর্ষণীয় করে তোলা, ছাত্র-ছাত্রীদের ফিরিয়ে আনা, তাদের ক্লাসে ধরে রাখা এবং পড়াশোনাটাকে জবাবদিহির আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
সিলেবাস সংস্কার
সিলেবাস সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম, কলেজগুলোয় অনার্স-মাস্টার্স বা গ্র্যাজুয়েশন কোর্সের নামে যা পড়ানো হচ্ছে, তার সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়ার কোনো যোগাযোগ নেই। মাঠ প্রশাসন কী চাচ্ছে, নিয়োগদাতারা কী চাচ্ছে, এদেশের সমাজ-সংস্কৃতি ও মানুষের চাহিদা কী, দেশের অর্থনীতির চাহিদা কী, বাজারের চাহিদা কী, কোনো ধরনের পড়াশোনা করলে চাকরি পাবে—সেদিকে কোনো নজর নেই। সিলেবাসগুলো অনেক পুরোনো। আমরা অনার্সের প্রায় ৩২টি সিলেবাস সংস্কারে হাত দিয়েছি। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই সংস্কারকৃত সিলেবাসে পড়াশোনা শুরু হচ্ছে। এখন যে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে, তা সংশোধিত একটি সিলেবাসের মাধ্যমে শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেও অনেকে ইংরেজি বলতে পারে না, লিখতে পারে না। এ জন্য আমরা ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছি। সব অনার্স কোর্সের সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে কমিউনিকেটিভ ইংলিশ পড়তে হবে। এ জন্য আমরা আন্তর্জাতিক মানের একটি সিলেবাসও করেছি। পাশাপাশি সবার জন্য আইসিটি কোর্সকেও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। চলতি সেশন থেকেই এটি কার্যকর হচ্ছে। এতে ছেলেমেয়েদের মাঝে পড়াশোনা করার এক ধরনের উৎসাহ দেখা যাচ্ছে।
মানসম্পন্ন প্রশ্ন প্রণয়নের উদ্যোগ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন প্রণয়নে বেশ দুর্বলতা ছিল জানিয়ে উপাচার্য এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব প্রশ্ন করা হয় তার প্যাটার্ন এক। এক বছর গ্যাপ দিয়ে আরেক বছর প্রশ্ন করার এই ক্ল্যাসিক্যাল প্যাটার্ন থেকে আমরা বের হয়েছি। মডারেশন বোর্ডের সঙ্গে কথা বলে গত অনার্স এবং বিএ পরীক্ষায় প্রশ্নের ধরন মোটামুটি চেঞ্জ হয়েছে। এতে একশ্রেণির ছেলেমেয়েরা খুশি। আর যারা বই পড়ত না, গাইড বা অন্যভাবে পরীক্ষা দিত, তারা পড়াশোনায় আগ্রহী হচ্ছে।
তিনি বলেন, আগে পরীক্ষার খাতা পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা ছিল না। পুনর্নিরীক্ষণের সুযোগ ছিল। আমরা খাতা পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা করেছি। এতে অনেকেই পাস করে যাচ্ছে।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও এমপিওভুক্তির উদ্যোগ
শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও এমপিওভুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ জরুরি। কিন্তু এই ট্রেনিংয়ের তেমন ব্যবস্থা ছিল না। আমরা গত ১০ মাসে শিক্ষকদের প্রচুর ট্রেনিং শুরু করেছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য বড় বাজেট রাখা হয়েছে।
উপাচার্য বলেন, অনার্স মাস্টার্সের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষকের এমপিও ছিল না। তাদের অধিভুক্তি ছিল না। সরকারের সঙ্গে কথা বলে অনার্সের এই সাড়ে ৩ হাজার শিক্ষকের এমপিওভুক্তি আদায় করতে সক্ষম হয়েছি। শিগগিরই এটা চালু হবে। আমাদের মাধ্যমে এটা একটা বড় উদ্যোগ।
তিনি বলেন, সরকারি কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতি জটিলতার সমাধানে সরকারের সঙ্গে আমাদের দেনদরবার চলছে। এ বিষয়ে সরকার ও মাউশিও কাজ করছে। আর আমাদের অধীনে এমপিওভুক্ত বেসরকারি কলেজগুলোয় শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ক্রেডিট কোর্সের উদ্যোগ
উপাচার্য আমানুল্লাহ বলেন, এটুআই এবং এনএসডিপির সঙ্গে মিলে বিশ্বের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কথা বলে অনার্সে একটা ট্রেড কোর্স চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা ১৪০ ক্রেডিটের অনার্স কোর্সের সঙ্গে ২০ ক্রেডিটের ট্রেড কোর্সও করবে। ১৪০ ক্রেডিটের কোর্সে কিছু সাবজেক্ট রিপিটেড হিসেবে শনাক্ত করেছি। সেই জায়গাগুলো থেকে একটু ড্রপ ও সমন্বয় করে প্রায় ২০ ক্রেডিটের একটা ট্রেড কোর্স চালুর চিন্তাভাবনা করেছি। এ জন্য শিক্ষার্থীরা ট্রেড কোর্সের আলাদা সার্টিফিকেট পাবে। ফ্রিল্যান্সিং, কারিগরি, ইলেট্রো মেকানিক্যাল বা সেফ হতে যে যেই ট্রেড পছন্দ করবে, সে সেটাই পড়বে। পাস করার পর তারা যাতে দেশের ভেতরে ও বাইরে অন্তত একটা চাকরি পায় অথবা উদ্যোক্তা হতে পারে। এটা কীভাবে পড়ানো হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে এ বিষয়ে সিন্ডিকেট এবং সিনেটে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে একটা হিসাব ও মডেলিংও করে দেখা গেছে বছরে যে ৭/৮ লাখ লোক বিদেশে যায়, তাদের বিরাটসংখ্যক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অথবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপ আউট হওয়া। তাদের যদি ট্রেড কোর্সের সার্টিফিকেট দিতে পারি তাহলে রেমিট্যান্স ৫০ বিলিয়ন থেকে ১০০ বিলিয়নে নিতে পারি। তাতে তার বেতন ৩০-৪০ হাজার থেকে ৬০-৭০ টাকা হবে। যেটা ভারতে, পাকিস্তানে, শ্রীলঙ্কা এমনকি নেপালেও আছে।
৩২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র হচ্ছে
৩২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথা জানিয়ে উপাচার্য বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেখান থেকে কষ্ট করে তাদের গাজীপুরে আসতে হয় বিভিন্ন কাজে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দুটি জেলা মিলিয়ে একটা আঞ্চলিক কেন্দ্র করব। ৩২টি কেন্দ্র করলে শিক্ষকদের খাতা নেওয়া ও পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার জন্য আর কষ্ট করতে হবে না। এরই মধ্যে বগুড়া এবং হবিগঞ্জে আঞ্চলিক কেন্দ্র উদ্বোধন করেছি। আগামী মাসের মধ্যে কুমিল্লা, ঝিনাইদহ ও ময়মনসিংহে আঞ্চলিক কেন্দ্র উদ্বোধন করতে যাচ্ছি। বর্তমানে আটটি আঞ্চলিক কেন্দ্র আছে। এটাকে বাড়ানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘এক্সাম ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এএমএস)’ নামে একটা সফটওয়্যার চালু করা হয়েছে। এটাকে আমরা আরো আপডেট করছি। এতে সাত-আট লাখ শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেওয়া মাত্রই তাদের হাজিরা সার্ভারে চলে আসে। এই সিস্টেমটা অটোমেশনের দিকে যাচ্ছে। আমরা ওএমআর, অত্যধিক কাগজের ব্যবহার কমানোর দিকে যাচ্ছি।
কলেজের জায়গা কাজে লাগানো
উপাচার্য জানান, কলেজগুলোয় যে জায়গা আছে, বিশেষ করে শতবর্ষী কলেজগুলোয় অনেক জায়গার অপব্যবহার হয়। এই কলেজ ক্যাম্পাসগুলোকে গ্রিন ক্যাম্পাস করা যায় কি না দেখছি। কলেজে হোম গার্ডেনিং, সোলার সিস্টেম চালু করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি
শিক্ষার মান উন্নয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা এরই মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে দক্ষতা উন্নয়নে এটুআইয়ের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছি। আমরা ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের সঙ্গেও (এনএসডিএফ) একটা চুক্তি করেছি। সেই চুক্তি অনুযায়ী আমাদের কাজও শুরু হয়েছে। সিলেবাস সংস্কার, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও গুণগত শিক্ষাবিস্তারে ইউনিসেফের সঙ্গে একটা চুক্তি হয়েছে।
ক্যারিয়ার ক্লাব প্রতিষ্ঠা
উপাচার্য বলেন, ইতোমধ্যে আমরা কলেজগুলোয় ছেলেমেয়েদের জন্য ক্যারিয়ার ক্লাব করেছি। লালমাটিয়া কলেজ দিয়ে আমরা এটা শুরু করেছি। সেখানে বিদেশি একটি সংস্থা আমাদের সাহায্য করেছে। অন্যান্য ক্লাবেও এই ক্লাব করা হচ্ছে।
নকলবিরোধী কঠোর অবস্থান
অধ্যাপক আমানুল্লাহ বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার সময় নকল একটা বড় বিষয় হিসেবে দেখা দেয়। অনার্স, মাস্টার্স, বিএড পরীক্ষায় ব্যাপক নকল হয়। এটি বন্ধে কম্বো অ্যাটাক শুরু হয়েছে। যে কারণে গত আইন পরীক্ষাটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছি, সেখানে শক্ত ভূমিকা পালন করেছি। আস্তে আস্তে আমরা ল কলেজ, বিএড কলেজ, অন্যান্য ফিজিক্যাল কলেজ, পুলিশ সায়েন্স কলেজ, আনসার একাডেমি, পিআইবি, লাইব্রেরি সায়েন্স কলেজগুলোয় আমরা আধুনিকায়নের দিকে যাচ্ছি। তাদের জবাবদিহির মধ্যে আনার কাজ শুরু করেছি। সেটার ফল শিগগিরই পাওয়া যাবে। এ ব্যাপারে আমরা সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটিশসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দেশের সহযোগিতার আশ্বাস পাচ্ছি।
এমফিল-পিএইচডির স্ট্র্যাকচার পরিবর্তন
উপাচার্য বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজ শিক্ষক অথবা সমাজের অন্যান্য শ্রেণির মানুষের জন্য এমফিল-পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু আছে। সেই প্রোগ্রামের পুরো স্ট্র্যাকচার আমরা পরিবর্তন করে দিয়েছি। সেখানে এমফিল-পিএইচডি গবেষকরা প্রকৃতপক্ষে যাতে কিছু শিখতে পারেন, সেই জায়গাতে আমরা লোকজন নিয়োগ করছি।
মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলিং
তিনি বলেন, চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেই ক্ষতি থেকে বের করে আনতে আমরা সারা দেশে মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলিং শুরু করেছি। এরই মধ্যে অনেকগুলো কলেজে এই প্রোগ্রাম চালু হয়েছে। ছেলেমেয়েদের ক্লাসে ও খেলাধুলায় ফিরিয়ে আনার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস এবং কালচারাল প্রোগ্রাম আয়োজন করেছে। সামনে জাতীয় পর্যায়ে সেই অনুষ্ঠান হবে। মোটামুটি এগুলো নিয়েই এগোচ্ছি।
উচ্চশিক্ষায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ও বাস্তবতা
এ প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, বাস্তবতা খুবই খারাপ। আমাদের পরিকল্পনা হলোÑযেহেতু শিক্ষার ৭০ ভাগ শিক্ষাব্যবস্থা আমরা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করি, এটাকে একটা বিশ্বজনীন হিসেবে গড়ে তোলার আগে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শিক্ষার সঙ্গে তুলনামূলক বা তাদের সমকক্ষ হতে পারি কি না, সেই চেষ্টা চালাচ্ছি। তারপর আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ধারায় যাওয়ার চিন্তা করব।
এ জন্য শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো, তাদের ট্রেনিং দেওয়া, কলেজগুলোয় আরো রিসোর্চ দেওয়া, কলেজগুলোকে জবাবদিহির ভেতরে আনা, কলেজ মনিটরিং আরো বৃদ্ধি করা, অডিটিং চালু করা, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনাকে আরো গ্রহণযোগ্য ও আগ্রহী করে তোলার কাজগুলোয় আমরা হাত দিয়েছি।
মানহীন কলেজ ও শিক্ষকদের বিষয়ে শক্ত অবস্থান
উপাচার্য বলেন, যারা একবার কলেজে ঢুকে গেছে, তাদের চট করে বের করে দেওয়া যাচ্ছে না। কলেজ গভর্নিং বডি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে, যদি শিক্ষকরা সেখানে কন্ট্রিবিউট করতে পারে, তাহলে তারা সেখানে থাকবেন আর যদি অবদান না রাখতে পারেন, খুব বেশি দলবাজির সঙ্গে যুক্ত হন, পড়াশোনার প্রতি যদি আগ্রহী না থাকেন, তাহলে গভর্নিং বডির সুপারিশ অনুযায়ী আমরা কাজ করছি।
তিনি বলেন, বিগত সময়ে যত্রতত্র অনার্স-মাস্টার্স খোলা হয়েছে। যত্রতত্র মানুষদের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে অনেক সমস্যা হয়ে গেছে। সেই জায়গাগুলো ঠিক করতে সময় লাগবে, তবে আমরা এগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমরা কিছু কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের চিন্তা করছি, যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে আসবে না, তাদের বিষয়ে আমরা শক্ত ভূমিকা পালন করছি।
উন্নয়ন পরিকল্পনার দৃশ্যমান অগ্রগতি
উপাচার্য বলেন, আগামী বছরের জুনের ভেতরে আমরা প্রায় ২০টি পরীক্ষা নেব। এরই মধ্যে গত ১০ মাসে ২২টি পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। জুনের মধ্যে যদি ২০টি পরীক্ষা নিতে পারি, তাহলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সেশনজট ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক দক্ষতা, সুশাসন, গুড গভর্নেন্স নিশ্চিত করতে আমরা জিরো টলারেন্সে চলছি। এখানে কোনো ধরনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির প্রশ্রয় দিচ্ছি না। এরই মধ্যে পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে, আগামী মাস-ছয়েকের মধ্যে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। বিগত সময়ে যে ধস নেমেছিল, সেই অবস্থা থেকে তুলে আনতে হচ্ছে।
জুলাই শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ
উপাচার্য আমানুল্লাহ বলেন, দেশের উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শতকরা ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে তারা দেশের স্বার্থে অংশ নেয়, তাদের ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় ইতোমধ্যে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি শিক্ষাবৃত্তি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজের শহীদ পরিবার ও আহত শিক্ষার্থীদের সব ধরনের ফি মওকুফ করা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি রক্ষায় আরো অনেক পরিকল্পনা রয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে।
শিক্ষার চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা
উপাচার্য বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে শিক্ষাব্যবস্থা চলছে, তা চতুর্থ শিল্প-বিপ্লব তো দূরের কথা, প্রথম শিল্প-বিপ্লবকেও মোকাবিলা করার মতো নয়। যুগান্তকারী তো নয়ই। দেশে অনেকগুলো শিক্ষাকমিশন হয়েছে, কিন্তু কোনোটার রিপোর্ট বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলা, ইংরেজি, ন্যাশনাল ভার্সন, উর্দু মিডিয়াম, মাদরাসাশিক্ষা, কারিগরি শিক্ষাÑসব মিলিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা একটা হযবরল অবস্থায় আছে। গত ১৫ বছরে আরো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যার জন্য আগামী ৫০ বছর বাংলাদেশকে ভুগতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের কারিকুলাম জটিলতা থেকে বের হয়ে আসতে একটা স্থায়ী শিক্ষা কমিশন লাগবে। এ জন্য আমরা জোর তদবির চালাচ্ছি। শিক্ষা খাতে যেসব মাফিয়া ও কায়েমি স্বার্থান্বেষীরা দখল করে বসে আছে, তা থেকে বের হয়ে আসতে অনেক ধরনের পলিসিগত সাপোর্ট লাগবে। এ বিষয়ে সরকারকে অবগত করেছি।
তিনি বলেন, সব কলেজের শিক্ষার স্ট্যান্ডার্ড মান বজায় রাখার জন্য সরকারের পলিসি সাপোর্ট লাগবে। এ বিষয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি।
উপাচার্য বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভারত এমনকি নেপাল থেকেও পিছিয়ে আছে। আমরা এসডিজির টার্গেটগুলো অর্জন করতে পারব বলে মনে হয় না। তাই এই টার্গেট পূরণ করতে হলে এবং সত্যিকার অর্থে আমাদের একটি মধ্যম আয়ের দেশে যেতে হলে, বিশ্বে একটা মোটামুটি একটা সভ্য জাতি হিসেবে পরিচিত করতে চাইলে, প্রধানত শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার ছাড়া কোনো কিছুতেই সম্ভব হবে না।