
২০২১ সালে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই। এরপর থেকে হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। তার কাছে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক থেকে শুরু করে আইনজীবী, শিক্ষক, ইউপি সচিব ও ব্যবসায়ি। কথায় কথায় সাধারণ মানুষকে করেন মারধর। ইউনিয়ন পরিষদে সালিশি বৈঠকে তাঁর কথা না শুনলে সাঙ্গপাঙ্গ দিয়ে মারধরেরও একাধিক অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। মারপিটের ঘটনায় একাধিকবার কারাগারে যেতে হয়েছে তাঁকে। এমনকি সাময়িক বহিষ্কারও হতে হয়েছে। কিন্তু কোন কিছুতেই দমানো যায়নি তাঁকে। এখন পর্যন্ত দাপটের সাথে এলাকায় তাঁর নিজস্ব বাহিনী নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি হলেন, খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। এলাকায় তিনি ডন মাহমুদ নামে পরিচিত। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর স্থানীয় নেতা-কর্মীরা গা ঢাকা দিলেও তিনি আছেন বহাল তবিয়তে। সম্প্রতি একটি মতবিনিময় সভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ করে স্থানীয় বিএনপি। ওই সমাবেশে তাঁকে অপসারণ এবং গ্রেপ্তারের দাবিতে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয় বিএনপি নেতারা। কিন্তু কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে বহালতবিয়তেই আগের মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করায় বর্তমানে ভিন্ন কৌশল নিয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ নেতা মাহমুদ। বর্তমানে এলাকার রাজনীতিবীদ, সাংবাদিক ও আইনজীবীর চরিত্রহনন করে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করছেন। এ বিষয়ে থানায় একাধিক সাধারণ ডায়রী হয়েছে। গত ৩১ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে একটি পত্রিকায় ভিডবিøউডি’র সুবিধাভোগী নারীদের সঞ্চয়ের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ওই সাংবাদিকের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার ও হুমকি দিয়েছেন তিনি। এ ব্যাপারে গত ১ জুলাই সামাজিক ও জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে তাঁর নাম উল্লেখ করে থানায় সাধারণ ডায়রী করেছেন ওই সাংবাদিক। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, চেয়ারম্যানের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলে তাঁর বাহিনী দিয়ে তুলে নিয়ে নির্যাতন করেন। কয়রা উত্তরচক কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ নিয়োগকে কেন্দ্র করে ২০২৩ সালের ৫ মে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক নজরুল ইসলামকে চেয়ারম্যানের বাড়িতে ডেকে নিয়ে মারপিট করে হাত ভেঙে দেওয়া হয়। তিনি ওই নিয়োগ বোর্ডের প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। চেয়ারম্যানের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে না চাওয়ায় তাঁকে মারপিট করা হয়। পরে এ বিষয়ে মামলা হলে কারাগারে যেতে হয় চেয়ারম্যানকে। ২০২২ সালের ২১ মার্চ ইউনিয়ন পরিষদের একটি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের প্রতিবাদ করায় ইউপি সচিব ইকবাল হোসেনকে তাঁর বাড়ি থেকে তুলে এনে পরিষদের কক্ষে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। পরে ওই ইউপি সচিবের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইউপি নির্বাচনে বিরোধিতা করায় আব্দুর রাজ্জাক নামে এক আইনজীবিকে চেয়ারম্যানের বাহিনী রাস্তায় ফেলে রড ও হাতুড়ি দিয়ে মারপিট করে পা ভেঙে দেওয়া হয়। পরে ওই আইনজীবীর মামলায়ও কারাগারে যেতে হয় চেয়ারম্যানকে। চেয়ারম্যানের বাবার নাম ভুল বলায় ইউনিয়নের মঠবাড়ি গ্রামের আনোয়ারা খাতুন নামে এক নারীকে চেয়ারম্যানের বাড়িতে দিনভর আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে। ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম খোকা জানান, ওই নারী তাঁর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। ভাতার টাকা না পাওয়ায় তিনি চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলেন। বাড়ি চিন্তে না পারায় তিনি চেয়ারম্যানের বাবার নাম ধরে বাড়ি দেখিয়ে দিতে বলেন। এলাকায় চেয়ারম্যানের বাবাকে যে নামে ডাকা হয় সেই নাম বলায় চেয়ারম্যানের কাছে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ওই নারীকে। পরে চেয়ারম্যানসহ তাঁর ভাগনে ও কয়েকজন মিলে ওই নারীকে নির্মমভাবে নির্যাতন করেন। সে সময় এ বিষয়টি নিয়ে এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় হয়। পরে ওই নারীর বাড়িতে গিয়ে ঘটনা মীমাংসা করে নেয় চেয়ারম্যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ইউপি সদস্য অভিযোগ করেন, ইউনিয়নের যে কোন প্রকল্প বাস্তবায়নে সব সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে থাকেন। নিয়ম অনুযায়ি সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা থাকলেও তিনি তা করেন না। জানা গেছে, ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি ও তাঁর স্ত্রী ৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নেন। এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।জানতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলছেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার ব্যুরো কয়রা উপজেলা শাখার সভাপতি তরিকুল ইসলাম বলেন, অনলাইন প্লাটফর্মে রাষ্ট্রের নাগরিকদের সম্মানহানিকর কোন কিছু প্রচার করা অথবা কাউকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড সমাজে বিশৃঙ্খলা বাড়ায়।