
রাজধানীর পল্লবী থানার মিল্লাত ক্যাম্প মানেই মাদকের ওপেন আস্তানা। ওই এলাকার সামাজিক চালচিত্র এখন অনেকটা পাল্টে গেছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ইস্যুতে বড় চ্যালেঞ্জে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এলাকায় খুন, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, অপহরণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মাদক-বাণিজ্য। হাত বাড়ালেই মিলছে সব ধরনের মাদক। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে জেলা হয়ে রাজধানীতে ঢুকছে মাদকের বড় বড় চালান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে মাদকের আগ্রাসন রুখতে। কিছু অসাধু রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের সদস্যদের ম্যানেজ করে মাদক কারবারিরা মাদক মারণনেশা পৌঁছে দিচ্ছে রাজধানীর সর্বত্র।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকায় বস্তিকেন্দ্রিক মাদক স্পট ও বিক্রেতার সংখ্যা বেশি। মিরপুর-১১ মিল্লাত ক্যাম্প বিহারি বস্তি এলাকা হচ্ছে রাজধানীর মাদকের আস্তানা। সাম্প্রতিক সময়ে এসব এলাকা থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর অভিযানে শতাধিক মাদক বিক্রেতা গ্রেপ্তার হয়েছে, তবু থেমে নেই মাদকের রমরমা বিকিকিনি।
সরেজমিনে মিরপুর-১১ মিল্লাত ক্যাম্পের বিহারী বস্তির কয়েকটি মাদক স্পটে গিয়ে জানা যায়, যারা নিয়মিত মাদকসেবী তারা ফোন করলেই মাদক দিয়ে যায়। এ মাদক বিক্রির কৌশল হিসেবে ফোনে ব্যবহার হয় সাংকেতিক ভাষা। এসব স্পটগুলোয় শুধু এলাকার আশপাশের লোকজনই কাস্টমার নয়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদকাসক্ত ক্রেতারা এসে মাদক ক্রয় করতে দেখা গেছে। মাদকদ্রব্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা গাঁজা, ইয়াবা, হিরোইনের। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যে জানা গেছে, গত ৮ বছরে দেশে অন্তত ৩০ লাখ মাদকসেবী বেড়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটির বেশি। মাদকসেবীদের বেশিরভাগ তরুণ-তরুণী।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের তথ্যমতে, ঢাকায় সংঘটিত অধিকাংশ অপরাধের পেছনে রয়েছে মাদক। মাদক সরবরাহে বাহক হিসেবে এখন নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। স্কুল পড়ুয়া কিশোরী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অনেক তরুণী মাদকের বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, অপরাধ বিশেষজ্ঞ, মাদক বিক্রেতা, পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এবং ভারত থেকে আসে ফেনসিডিল। আর দেশে এখন ইয়াবার ব্যাপক বিস্তার। গণঅভ্যুত্থানকালে পুলিশের ভূমিকার কারণে দেশব্যাপী থানাগুলো জনতার রোষানলের শিকার হয়। এরপর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কার্যক্রমে কিছুটা ভাটা পড়ে। এ পরিস্থিতিতে মাদক কারবার অনেকটাই নির্বিঘ্ন হয়ে পড়েছে।
গতকাল বিকেলে রাজধানীর মিল্লাত ক্যাম্প এলাকার এক মাদক কারবারী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মিল্লাত ক্যাম্প এলাকায় গাজা এবং হিরোইনের অনেক চাহিদা। নিয়মিত কাস্টমাররা ফোন করলেই জায়গা মতো পৌঁছে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, প্রতিটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে একেকজন ডিলার। একজন ডিলারদের অধীনে থাকে ১৫ থেকে ২০ জন করে বিক্রেতা। এ বিক্রেতারাই ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে।
সরেজমিনে মিল্লাত ক্যাম্প এলাকায় দেখা গেছে, সেখানে অনেকটা প্রকাশ্যেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিক্রি হচ্ছে গাঁজা, ইয়াবা; এমনকি হেরোইন পর্যন্ত। মাদক বিক্রির জন্য ক্রেতার অপেক্ষা করছেন মাদক কারবারিরা। আর ক্রেতারাও প্রকাশ্যে তাদের কাছে কিনছেন মাদক। বেশিরভাগ ক্রেতাই সিএনজি এবং রিক্সা চালক, বাসের হেলাপারসহ নিম্নআয়ের মানুষ। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় চা-দোকানদার বলেন, এই তো সামনেই থানা, তাদের সামনেই প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করছে। ক্যাম্পের অনেকে মাদক ব্যবসা করেন। এটা প্রশাসনের জন্য অজানা কাহিনী নয়।
সূত্র আরো জানায়, পল্লবী থানার প্রায়ই অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে আগে থেকেই পরিচিত। উর্দুভাষী অনেকেই মাদক কারবারি। মিল্লাত ক্যাম্পের মাদক কারবারি গ্রুপগুলো হলো ভয়াবহ সিন্ডিকেট খুব শক্তিশালী। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির অসাধু সদস্য মাদক পাচার ও কারবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সমাজের প্রভাবশালী এবং শীর্ষ সন্ত্রাসীরা তাদের মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে পারে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাহলে আইনের শাসন এবং মানবাধিকার অবশিষ্ট আছে কি না? এ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেন।