
কাশ্মীরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার জের ধরে ফের মুখোমুখি হলো দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী — ভারত ও পাকিস্তান। মঙ্গলবার মধ্যরাতে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে সামরিক অভিযান চালায়। পাকিস্তানও পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় ভূখণ্ডে হামলা চালায়। এতে দুই পক্ষেই প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, তারা ‘অপারেশন সিন্দুর’ নামে একটি পরিকল্পিত সামরিক অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানে নয়টি স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এসব স্থাপনাকে সন্ত্রাসী ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, হামলার লক্ষ্য ছিল চরমপন্থী সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ এবং লস্কর-ই-তৈয়বার ঘাঁটি, যারা সম্প্রতি কাশ্মীরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি সাংবাদিকদের বলেন, “পেহেলগামের হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘রেসিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ নামের একটি সংগঠন, যার সরাসরি যোগ রয়েছে পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষিত লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে। এটি প্রমাণ করে যে, পাকিস্তান তার ভূখণ্ডকে এখনো সন্ত্রাসবাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করতে দিচ্ছে।”
পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান জানায়, ভারত ছয়টি স্থানে হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে বেসামরিক এলাকা, একটি মসজিদ ও স্কুলও রয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র মেজর জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী জানান, হামলায় দুই শিশু সহ অন্তত সাতজন নিহত এবং অনেকে আহত হয়েছেন। তিনি আরও দাবি করেন, পাকিস্তানের বিমান বাহিনী দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান এবং একটি ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে।
কাশ্মীর সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ রেখা ঘেঁষা অঞ্চলে এখনও গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। স্থানীয় সরকারি সূত্র জানিয়েছে, হিমালয়ের তিনটি ভিন্ন এলাকায় ভারতীয় তিনটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে এবং আহত তিন পাইলটকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে ভারতের তরফ থেকে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি।
পাকিস্তান ভারতের এই হামলাকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য’ উল্লেখ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অভিযোগ জানিয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেছেন, “শত্রুরা কাপুরুষোচিতভাবে আমাদের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়েছে। এর উপযুক্ত জবাব আমরা অবশ্যই দেব।” পাকিস্তান জানিয়েছে, তাদের জেট বিমানগুলো ইতিমধ্যেই প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনী জানিয়েছে, পাকিস্তানও পাল্টা হামলায় কাশ্মীরের পুঞ্চ-রাজৌরি সীমান্তবর্তী ভিম্বর গলিতে কামান থেকে গোলা নিক্ষেপ করেছে। এতে সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর মধ্যে টেলিফোনে এই সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, “এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। আমি চাই এই সংঘাত দ্রুত শেষ হোক।”
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র বলেছেন, “নিয়ন্ত্রণ রেখা ও সীমান্তে চলমান সামরিক উত্তেজনায় মহাসচিব গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি দুই দেশকেই সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন।”
পাকিস্তানের মুজাফফরাবাদ এলাকার বাসিন্দা শাহনওয়াজ বিবিসিকে বলেন, “রাতের গভীরে হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। আমরা আতঙ্কে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি, এখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঘুরছি।”
একই এলাকার আরেক বাসিন্দা মোহাম্মদ ওয়াহিদ বলেন, “প্রথম বিস্ফোরণের পরই আমার ঘর কেঁপে ওঠে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরও তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়ে।”
উল্লেখ্য, গত ২২ এপ্রিল পহেলগামের কাছের বৈসারণ পর্যটন স্পটে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত ও ১৭ জন আহত হন। সেই হামলার পর থেকেই ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ছিল, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল এই সামরিক অভিযানে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে এই উত্তেজনা যদি সামাল না দেওয়া যায়, তাহলে তা দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।