
সমকালীন বাংলা কবিতার ভুবনে স্বপন বিশ্বাস এক অনন্য স্বর। তাঁর কবিতায় যেমন থাকে অন্তর্জগতের নরম আবেগ, তেমনি উচ্চারিত হয় প্রতিবাদের কাঁপন—কখনো নিঃশব্দ, কখনো স্পষ্ট। তাঁর লেখায় ‘প্রেম’ ও ‘ভূমি’—এই দুটি বিষয়ের ভিন্নমাত্রিক প্রকাশ কবিতার ভাষা ও কাঠামোয় এনে দেয় ভিন্নতর বলিষ্ঠতা।ভূমি, ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের কবিতা“এই মাটি আমার” কবিতায় স্বপন বিশ্বাস বাংলা কবিতায় এক আত্মিক রাজনৈতিক উচ্চারণ নিয়ে হাজির হন। এখানে ‘মাটি’ শব্দটি কেবল ভূমি নয়—তা উত্তরাধিকার, মা, পিতা, আর রক্তের প্রতীক। কবি বলেন:
“তুমি ইতিহাস জানো না—
দখল নিলেই মালিক হওয়া যায় না।”
এই পংক্তিগুলোতে রয়েছে এক অবিচল আত্মবিশ্বাস ও প্রতিবাদ। ইতিহাস মুছে ফেলার বিপরীতে কবির ভাষা দাঁড়ায় অস্তিত্বের দলিল হয়ে। মাটি যে উত্তরাধিকার, তা কবি স্মরণ করিয়ে দেন– “এই মাটি শুধুই জমি নয়, এ মাটি আমার অস্তিত্ব, আমার পরিচয়।” এই কবিতা কেবল আবেগনির্ভর নয়, তা সময়ের দরজায় ছুঁড়ে দেওয়া এক রাজনৈতিক উচ্চারণ।
কবিতায় নারী, প্রেম ও নিঃশব্দ শরীরী অনুরণন একই কবির কলমে যখন উঠে আসে “নিঃশব্দ উন্মাদনা” বা “পর্দার আড়ালে”—তখন সেখানে আরেক স্বর আবির্ভূত হয়। এক গভীর প্রেম, কামনা ও আত্মিক আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। স্বপন বিশ্বাস নারীর শরীরকে কেবল আকর্ষণের বস্তু নয়, বরং এক রহস্যময় অস্তিত্ব হিসেবে দেখেন। তিনি লেখেন:
“তুমি তখন আর নারী নও—
তুমি এক উৎকণ্ঠার নেশা, এক ছিন্নগন্ধ কামনা।”
এই উচ্চারণ সাহসী, তীব্র, তবুও নান্দনিক। কামনা তাঁর কবিতায় নগ্নতা নয়, বরং একটি অদৃশ্য অনুভবের ভাষা। ‘পর্দার আড়ালে’ কবিতায় এমন এক প্রেমের চিত্র আঁকা হয়েছে যা নিঃশব্দ, অথচ তীব্র:
“তোমার চোখে জমে ছিল নিষিদ্ধ কামনার জ্যোতি,
আমার আঙুলের নরম ছোঁয়ায় খুলে যাচ্ছিল
তোমার অন্তর জুড়ে নিভৃত কবিতা।”
এখানে শরীর এবং আত্মা একাকার হয়ে যায়। কামনা হয়ে ওঠে অনুভব, আর অনুভব রূপ নেয় কাব্যিক স্পর্শে।
ভাষা ও চিত্রকল্পের মেলবন্ধন
স্বপন বিশ্বাসের কবিতার বড় বৈশিষ্ট্য হলো ভাষা ব্যবহারে তাঁর স্নিগ্ধতা ও দৃঢ়তা। শব্দ তাঁর হাতে হয়ে ওঠে চিত্র। কখনো তা জেগে ওঠা দেবতার নিঃশ্বাস, কখনো হারিয়ে যাওয়া রজনীর গন্ধ। এমন চিত্রকল্প পাঠককে আবেগে আচ্ছন্ন করে তোলে, কিন্তু কখনোই আবেগে ডুবে গিয়ে কবি ছন্দ ও ভাবনায় ভারসাম্য হারান না।
উপসংহার
স্বপন বিশ্বাসের কবিতার দুই প্রান্ত—একদিকে ভূমি ও ইতিহাসের দাবিদার একজন উত্তরসূরি, অন্যদিকে নিঃশব্দ উন্মাদনায় ডুবে থাকা প্রেমিক। এই দুই চরিত্রের সমন্বয়ে তৈরি হয় তাঁর কাব্য-পরিসর, যা বাংলা কবিতাকে দেয় এক নতুন মাত্রা। তাঁর কবিতা আবেগপ্রবণ হলেও কখনোই আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করে না, বরং আবেগকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে এক অন্তর্মুখী সৌন্দর্যে রূপ দেয়।
স্বপন বিশ্বাস নিঃসন্দেহে এই সময়ের এক সাহসী ও সংবেদনশীল কণ্ঠ, যাঁর কবিতার ভাষা হয়ে উঠেছে সময়ের বিবেক, আর হৃদয়ের নিঃশব্দ ধ্বনি।